Home Blog

আন্তর্জাতিক রাউন্ডে উত্তীর্ণ ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি

0

সারেঙ ডেস্ক
ফিলিপ সি. জেসাপ ইন্টারন্যাশনাল ল’ মুট কোর্ট প্রতিযোগিতা ২০২৫-এর ৯ম বাংলাদেশ কোয়ালিফাইং রাউন্ডে রেকর্ডসংখ্যক অংশগ্রহণকারী ৪৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ইন্টারন্যাশনাল রাউন্ডের জন্য উত্তীর্ন হয়েছে। বাংলাদেশ কোয়ালিফাইং রাউন্ডের নয়টি আসরের মধ্যে, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি এবার ষষ্ঠবারের মতো আন্তর্জাতিক পর্বে প্রতিযোগিতার অসামান্য সুযোগ পেলো। এর আগে, তারা তিনবার সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন, ডি.সি.-তে ও দুইবার অনলাইনে অংশগ্রহণ করেছে।

এ বছর ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি চতুর্থবারের মতো সরাসরি আন্তর্জাতিক পর্বে অংশ নেবে এবং ২০২৫ সালের ২৯ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন, ডিসি-তে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে।
এই প্রতিযোগিতায় ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ‘প্রিলিমিনারি রাউন্ডে’ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মাধ্যমে ৪৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১ম দল হিসেবে ‘এডভান্স’ রাউন্ডে উত্তীর্ণ হয়েছে। দলের সদস্যরা হল- মাহির চৌধুরী, ফারিহা নওশীন এবং সাকিব খন্দকার- দারুণ আইনি দক্ষতা প্রদর্শন করে ন্যাশনাল রাউন্ডে রানার্স-আপ ট্রফি অর্জন করে। এই অসাধারণ সাফল্যের পাশাপাশি, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির দুই জন ‘ওরালিস্ট’ এর মধ্যে একজন, মাহির চৌধুরী, প্রিলিমিনারি রাউন্ডে ৮৮ জন প্রতিযোগীর মধ্যে সর্বো”চ স্কোর অর্জন করে অন্যন্য অর্জনের স্বীকৃতি স্বরুপ ‘বেস্ট মুটার’ সম্মাননা লাভ করে।
এই সাফল্যটি, আইনি দক্ষতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষার্থীদের তাত্ত্বিক চর্চাকে উন্নীত করতে ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগ এবং ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি মুট কোর্ট সোসাইটি (ইইউএমসিএস) এর নিয়মিত প্রচেষ্টার ফলাফল। ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি তাদেও কোচ – এ.বি.এম ইমদাদুল হক খান, ওমর ফারুক তামিম এবং সম্মানিত অনুষদ সদস্যবৃন্দের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে, যারা এই যাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের নির্দেশনা এবং উৎসাহ এই মাইলফলক অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

ফিলিপ সি. জেসাপ প্রতিযোগিতা হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে প্রখ্যাত মুট কোর্ট প্রতিযোগিতা, যা আইন ছাত্রদের জন্য ‘মুটিং এর বিশ্বকাপ’ নামে পরিচিত। জেসাপ বাংলাদেশ, ইলসা বাংলাদেশ চ্যাপ্টার, হার্থ বাংলাদেশ এবং এআইইউবি এর সহযোগিতায়, ৯ম বাংলাদেশে জাতীয় কোয়ালিফাইং রাউন্ড আয়োজন করেছে।
ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি তাদের মুটিং দলের সাফল্যে অত্যন্ত গর্বিত এবং বিশ্ব মঞ্চে তাদের তাদের ধারাবাহিক সাফল্য কামনা করছে। এই অসাধারণ সাফল্যের জন্য দলের সদস্যদের অভিনন্দন!

মধুসূদনকে ভুলি কেমনে?

0

গোলাম কবির

যশোরের সাগরদাড়িতে অবস্থানকালে ছেলেবেলায় বিভিন্ন পণ্ডিতের কাছে রামায়ণ-মহাভারত ও অন্যান্য প্রচলিত বাংলা বই মধুসূদন পড়েছিলেন। জননী জাহ্নবী দেবী ছেলেকে গড়ে তোলার ব্যাপারে কোনো কার্পণ্য করেননি। আরবি-ফারসির সঙ্গে তখনই তাঁর পরিচয় হয়। কলকাতায় এসে মেধাবী মধুসূদন ইংরেজি পাঠে এত বেশি মশগুল হয়েছিলেন যে একলাফে বায়রন হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখেন।

মাদ্রাজে গিয়ে তিনি পত্রপত্রিকায় ইংরেজি চর্চা করে খ্যাতি অর্জন করেন। এখানেই শেষ নয়, দুটি কাব্যও রচনা করেন ইংরেজিতে। ‘ক্যাপটিড লেডি’ এবং প্রথম কাব্যটি সাধারণ ছন্দে লেখা হলেও দ্বিতীয় কাব্য ‘ভিশনস অব দ্য পাস্ট’ অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা। অনেকে মনে করেন, এটি কবি বায়রনের ‘ড্রিম’ শীর্ষক কবিতা স্মরণ করিয়ে দেয়।

 

ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য ইউরোপযাত্রার প্রাক্কালে জন্মভূমিকে স্মরণ করে একটি কবিতা লেখেন, ‘রেখো, মা, দাসেরে মনে!/সাধিতে মনের সাধ, যদি ঘটে পরস্বাদ মধুহীন করো না গো তব মন’

না, মধুসূদনকে আমরা ভুলিনি।

ইউরোপে গিয়ে ১৮৬২ থেকে ১৮৬৩ পর্যন্ত ভার্সাই নগরীতে অবস্থানকালে অমিত্রাক্ষর ছন্দে ১০০টি ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। অবশ্য পরবর্তী সংস্করণে আরো সাতটি কবিতা সংযুক্ত করে ১০৭টি চতুর্দশপদী কবিতার সংকলন প্রকাশ করা হয়। এই কবিতাগুলোতে তাঁর আত্মজীবনের বেশ কিছু অংশ সংযোজিত হয়েছে। এই যে ইংরেজি রচনা থেকে বাংলায় পদার্পণের কথা আবেগমথিত কণ্ঠে উচ্চারণ করেন : ‘হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন’—কবিতাটি পড়লে বোঝা যাবে, তিনি কোন বেদনার রসে আপ্লুত হয়ে মাতৃভাষায় কবিতা রচনায় ব্যাপৃত হন। এ কাব্যেই স্মরণ করেছেন তাঁর প্রিয় মানুষগুলোকে, তাঁরা দেশে-বিদেশে বিস্তৃত। ‘আত্মবিলাপ’ কবিতায় কবি তাঁর দগ্ধ হৃদয়ের কথা প্রকাশ করতে গিয়ে লিখেছেন : ‘আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিলু, হায়, তাই ভাবি রবে?’

১৮৬২ থেকে ১৮৭৩—এই ১২টি বছর মধুসূদন বাংলা সাহিত্য সাধনা করেন। এর মধ্যে নানা কষ্টে দিনাতিপাত করে তিনি যেসব কীর্তি রেখে গেছেন, তা সাধারণের পক্ষে বিস্ময়কর।

মধুসূদনের অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য দিয়েই আমরা  গর্ব করি। এ ছাড়া সনেট, আধুনিক জীবনঘনিষ্ঠ নাটক ‘প্রহসন’, তার তুলনা হয় না। মৃত্যুশয্যায় লিখেছিলেন ‘হেক্টর বধ’ নামের একটি মহাকাব্যাংশ। ২৯ জুন ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে দুপুর ২টার সময় আলিপুর দাতব্য চিকিৎসালয়ে তিনি মানবলীলা সংবরণ করেন।

মৃত্যুর আগে তিনি একটি এপিটাফ লিখেছিলেন, ‘দাঁড়াও পথিক জন্ম যদি তব বঙ্গে’। এপিটাফ নয়, তবে ঠিক এই রকমের হৃদয়ঝংকার ধ্বনিত হয়েছিল কবি ইমরুল কায়েসের সেরা কাব্য ‘মোয়াল্লাকা’র প্রথম—‘কেফা নাবকি মিন জেকরা হাবিবেও ওয়া মানজেলি’। প্রিয়া আর তার বাসস্থান স্মরণ করে একটু দাঁড়াও। আর মধুসূদন জন্ম যদি বঙ্গে হয়, তবে তাঁকে দাঁড়াতে বলেছেন। দাঁড়াতে বলার বিশেষত্ব হলো আমরা যেন কবির সুখ-দুঃখের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে অবহিত হই। আমরা কতটুকু সার্থক হয়েছি জানি না, ধর্মবোধের অবকাঠামোতে কবির কীর্তিকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। পঠন-পাঠনক্ষেত্রেও সেই একই অবহেলা। রবীন্দ্রনাথ বালকবেলায় সম্পূর্ণ ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য পড়েছেন, যুবকবেলায় আমরা এই কাব্যের একটি পর্ব পাঠ্য তালিকায় রেখে দায় সারছি। ওই যে বিলেত যাওয়ার প্রাক্কালে বললেন, ‘রেখো মা দাসেরে মনে’, অথবা ‘দাঁড়াও পথিক বর’ ইত্যাদি ভাবনায় কবির যে আকুতি প্রকাশ পেয়েছে, আমরা তারও মূল্য দিইনি।

১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যে কবি নারী স্বাধীনতা সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টি উম্মীলন করেন। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ‘তিলোত্তমা সম্ভব’ কাব্য, ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য কিংবা বহু কবিতায় কবি নারীকে জননীর স্থানে রেখে যেসব বাণী দিয়ে গেছেন, তা আজও আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে।

আমরা মধুসূদনের কবিত্বকে অভিনবত্বের কথা বলেছি। এটা সত্য যে ইউরোপীয় নাটকের ছায়া অবলম্বনে কোনো নাটক বাংলা সাহিত্যে আসেনি। মধুসূদন প্রথম পাশ্চাত্য পাঠকের অনুকরণে নাটক লেখা শুরু করলেন, যেখানে আত্মজীবনের ছায়া আছে বলে অনেকে মনে করেন। তবে ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ আর ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ প্রহসনে শুধু নতুন বিষয় নয়, ভাষার নতুনত্ব আমাদের চমত্কৃত করে। বাংলায় বর্ণিত গদ্যের ইতিহাসে তার উল্লেখযোগ্য সন্ধান পাই না। আমাদের অনেক দুঃখের মধ্যে মধুসূদনের যথার্থ মূল্যায়ন না হওয়া আমাদের জাতীয় দুর্বলতার স্বাক্ষর।

(সদ্যঃপ্রয়াত অধ্যাপক গোলাম কবিরের অপ্রকাশিত নিবন্ধ)

আনোয়ারা সৈয়দ হকের ‘বাসিত জীবন’

0

সারেঙ ডেস্ক

যে বইয়ের পাতার পর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ভাবছি এই বুঝি শেষ জীবনের কিনার! মন অদ্ভুত বিষাদে ভরে উঠছে। ভাবছি পাখায় পাখায় এত এত রং নিয়ে, এত ওড়াওড়ি শেষে জীবন ফুরিয়ে কোথায় গেলেন কবি? সেই বইয়ের নাম ‘বাসিত জীবন’। যে জীবন নদী, ঝরনা আর পাহাড়ের মতো সব্যসাচি লেখক সৈয়দ শামসুল হক আর আনোয়ারা সৈয়দ হক হয়ে বয়ে গেছেন ওতপ্রোতভাবে একই সমান্তরালে।

আপাদমস্তক যিনি লেখক, সাহিত্যকে ভালোবেসেছেন প্রাণপণে, শয়নে-স্বপনে কেবল লেখার কথাই ভেবেছেন, এমনকি নিশ্চিত মৃত্যু এগিয়ে আসছে জেনেও লিখে গেছেন মরিয়া হয়ে মৃত্যুকে প্রতীক্ষায় বসিয়ে—তিনি সৈয়দ শামসুল হক। যিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন ‘যেকোনো যুদ্ধে হেরে গেলেই আমরা সাধারণ হয়ে যাই। হতে পারে সেটা জীবনযুদ্ধ বা সত্যিকারের কোনো যুদ্ধ।’ সেই মানুষটির গোটা জীবন নিয়ে তিনি নিজেই একটা উপন্যাস।

সৈয়দ শামসুল হক চিরদিন স্রোতোধারা হয়ে বইবেন বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে। সৈয়দ হকের সঙ্গে কাটানো শেষ দিনগুলোর কথা আনোয়ারা সৈয়দ হকের ‘বাসিত জীবন’ বইটিতে পাই অনেকটা দিনপঞ্জির মতো করে। চিরচেনা সৈয়দ হককে অন্য আলোয় দেখার সুযোগ করে দিলেন ‘হেমিংওয়ে’র সহযাত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হক।

২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাস বাড়ির কুকুর ভুলু ওরফে পেরির প্রতিরাতের কান্না দিয়ে বইটির শুরু। লেখা এগোতে থাকে ৮০তম জন্মবার্ষিকীতে সন্মাননা গ্রন্থ বের করার প্রস্তুতি থেকে মোড়ক উন্মোচনের দিনের দিকে। মাঝে কবিতা পরিষদের সৈয়দ হকের জন্মদিন উদযাপনের বর্ণনা ও লেখকের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও মনোজগতের নানা ভাবনার পথ অতিক্রম করে। অনেকটা সময় এগিয়ে এসে ১২ এপ্রিল, ২০১৬ জানা যায় ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত সৈয়দ হক। তারপর দিন থেকে ১৫ এপ্রিল লন্ডনের ফ্লাইটে ওঠার আগে অবধি লেখকের লেখায় যেমন দম্পতির অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে, তেমনি সৈয়দ হকের শক্ত মনোবলের দেখা মেলে। আবার এমন মানুষের দেখাও মেলে যে বা যাঁরা পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আর কখনো দেখা করেন না। কিন্তু হক দম্পতি অগণিত মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন, অসংখ্য মানুষ সময়ে-অসময়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সেই গল্পও গোটা লেখায় পাই।

আনোয়ারা সৈয়দ হকের প্রখর স্মৃতিশক্তির স্বাক্ষর মেলে সেপ্টেম্বর, ২০১৬-এর দিনলিপিতে। বইয়ের শুরুতেই প্রসঙ্গ কথায় তিনি লিখেছেন, ‘৩১ আগস্ট দেশে ফিরে আসার পর পরিবেশের চাপে আর সে রকমভাবে তারিখ অনুযায়ী, আমি লিপিবদ্ধ করতে পারিনি। ফলে পুরো সেপ্টেম্বরের দৈনন্দিন ইতিহাস আমার স্মৃতি থেকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।’ কিন্তু সেপ্টেম্বরের দিনলিপি পড়তে গিয়ে এমন ছোট ছোট বিষয় চোখে পড়েছে, যেগুলো পড়তে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে তিনি শুধু সব মনে রাখেন না, আবেগহীন হয়ে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাও রাখেন, এমনকি খুব ব্যক্তিগত এবং বেদনাদায়ক বিষয়েও। ত্রিপুরায় কিনে দেওয়া সোনার পাত বসানো দুটি শাঁখাচুড়ির কথা যখন সৈয়দ হক মনে করলেন, সেই ঘটনাক্রমের সঙ্গে চুড়ি দুটি না পাওয়ার বেদনা যেভাবে জুড়ে দিলেন, তাতে কেবল হেমিংওয়ের প্রতি লেখকের অপত্য ভালোবাসাই যে ফুটে ওঠে, তা-ই নয়, সামলে নেওয়ার সুন্দর অভিব্যক্তিরও প্রকাশ ঘটে।

দুই শ চৌষট্টি পৃষ্ঠার বইটি পড়তে শুরু করলে শেষ না করে পাঠক উঠতে পারবেন না—লেখার গতি ও সুসম্পাদনা চুম্বকের মতো বইটিতে ডুবিয়ে রাখে। পাঠক যদি সৈয়দ হকপ্রেমী হন, তবে চাইলেও বইটি শেষ না করে ওঠা কঠিন; বরং অন্য কোনো কাজকে সৈয়দ হকের মতো করে বলতেই পারেন—গুলি মারো!

 

১৩ গুণীজন পেলেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ফেলোশিপ

0

শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বাংলা একাডেমির ৪৭তম সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরে পুরস্কার ও ফেলোশিপপ্রাপ্ত গুণীজনদের হাতে পুরস্কারের অর্থমূল্য, সম্মাননাপত্র, সম্মাননা-স্মারক ও ফুলেল শুভেচ্ছা তুলে দেন একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক এবং মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম।

এবছর  বাংলা একাডেমি পরিচালিত ‘সা’দত আলি আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার-২০২৪’ (মরণোত্তর) পেয়েছেন সদ্য প্রয়াত অনুবাদক ও গবেষক মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ। এছাড়া ‘সাহিত্যিক মোহম্মদ বরকতুল্লাহ প্রবন্ধসাহিত্য পুরস্কার-২০২৪’ পুরস্কার পেয়েছেন প্রাবন্ধিক-গবেষক ড. ওয়াকিল আহমদ, ‘কবীর চৌধুরী শিশুসাহিত্য পুরস্কার-২০২৪’ পুরস্কার পেয়েছেন শিশুসাহিত্যিক আবু সালেহ, ‘অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ নাট্যজন পুরস্কার-২০২৪’ পুরস্কার পেয়েছেন নাট্যজন নায়লা আজাদ, ‘আবু রুশ্দ সাহিত্য পুরস্কার-২০২৪’ পুরস্কার পেয়েছেন কথাসাহিত্যিক নাসিমা আনিস, সামগ্রিক অবদানের জন্য ‘রাবেয়া খাতুন কথাসাহিত্য পুরস্কার-২০২৪’ পুরস্কার পেয়েছেন কথাসাহিত্যিক সুশান্ত মজুমদার এবং অনূর্ধ্ব ৪৯ বছর বয়সী লেখকদের মধ্যে ২০২৩ সালে প্রকাশিত ‘রাইমঙ্গল’ উপন্যাসের জন্য ‘রাবেয়া খাতুন কথাসাহিত্য পুরস্কার-২০২৪’-এ ভূষিত হয়েছেন কথাসাহিত্যিক সুমন মজুমদার।

আর বাংলা একাডেমি সম্মানসূচক ফেলোশিপ-২০২৪ প্রাপ্তরা হচ্ছেন- মঈদুল হাসান (মুক্তিযুদ্ধ), রিচার্ড এম ইটন (ইতিহাস), অধ্যাপক ডা. সায়েবা আখ্তার (চিকিৎসাবিজ্ঞান), ড. ফেরদৌসী কাদরী (বিজ্ঞান), সুগত চাকমা (ভাষা গবেষণা),  শহিদুল আলম (শিল্পকলা) ও শম্ভু আচার্য (শিল্পকলা)।

এর আগে সাধারণ সভায় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন এবং একাডেমির সচিব মোহা. নায়েব আলী ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেট অবহিত করেন। বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের সভাপতিত্বে একাডেমির সদস্যরা বার্ষিক প্রতিবেদন ও বাজেট সম্পর্কে সাধারণ আলোচনায় অংশ নেন। সদস্যদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন এবং উত্থাপিত প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে মহাপরিচালক বক্তৃতা করেন।

সারা দেশ থেকে আগত একাডেমির ফেলো, জীবনসদস্য ও সাধারণ সদস্যদের সম্মতিক্রমে ২৫ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে অনুষ্ঠিত ৪৬তম বার্ষিক সাধারণ সভার কার্যবিবরণী অনুমোদন ঘোষণা করা হয়।

বাংলা একাডেমির ৪৭তম সাধারণ পরিষদের বার্ষিক সভার কার্যক্রম পরিচালনা করেন, একাডেমির উপ-পরিচালক সায়েরা হাবীব, কাজী রুমানা আহমেদ সোমা, ড. সাহেদ মন্তাজ, রোকসানা পারভীন স্মৃতি এবং সহপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ড. মাহবুবা রহমান।

গদ্য ছন্দের কবিতা অনেক বেশি উদার এবং অতিথিপরায়ণ : রবীন্দ্রনাথ

0

আবদুল্লাহ জাহিদ

নিউইয়র্ক টাইমসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। প্রথম সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন কবি জয়েস কিলমার। তিনি সে সময় নিউইয়র্ক টাইমসের স্টাফ রিপোর্টার ছিলেন। নিয়মিত বুক রিভিউ লিখতেন। তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা হলো ‘ট্রি’ (Tree)। তাঁর জন্ম ১৮৮৬ সালে, নিউজার্সিতে। ১৯১৮ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর নেওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় ১৯১৬ সালের ১০ অক্টোবর।

সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে প্রশ্ন ছিল—কবির সঠিক কাজটি কি তাঁর অনুগামীদের নির্দেশনা দেওয়া বা ব্যাখ্যা করা? উত্তরটি গীতাঞ্জলি এবং চিত্রার রচয়িতা লেখকের কাব্যিক ধর্ম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

জবাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘কবির যথাযথ কাজ তাঁর অনুগামীদের নির্দেশনা বা ব্যাখ্যা দেওয়া নয় বরং সংগীতের পরিপূর্ণতায় তাঁর জীবনে যে সত্য এসেছে তা প্রকাশ করা।’

ঠাকুর ভারতের একটি বিখ্যাত পরিবার। কবির পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন মহান ধর্মীয় গুরু। তাঁকে ডাকা হতো মহর্ষি। কবির পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন একজন দানবীর ও সমাজ সংগঠক এবং একজন জমিদার। অন্যান্য ঠাকুরদের মধ্যে প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, আইন এবং শিক্ষাবিষয়ক লেখক, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিখ্যাত চিত্রকর, মহারাজা রমানাথ ঠাকুর একজন বিশিষ্ট লেখক ও রাজনৈতিক নেতা।

রবীন্দ্রনাথ যখন বালক, তখন তাঁর পিতা তাঁকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে হিমালয়ে নিয়ে তাঁকে প্রকৃতি প্রভাবে শিক্ষা দেন। তিনি নিজে তাঁর কবি সন্তানকে ইংরেজি, সংস্কৃত, বাংলা, বোটানি এবং জ্যোতির্বিদ্যার শিক্ষা দেন। ১১ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথকে গঙ্গার ধারে চন্দ্রানগরে থাকতে হয়, যেখানে তিনি ছয় বছর থাকেন এবং ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যের ওপর শিক্ষা লাভ করেন। ১৭ বছর বয়সে তিনি ইংরেজি শিখতে এবং ইংরেজি সাহিত্য সম্পর্কে জানতে ইউরোপে যান।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন বহুমুখী কর্ম শক্তিসম্পন্ন স্থিরমতি লেখক। যিনি একাধারে কবিতা ও গীত রচনা করেছেন, নাটক এবং ছোট গল্প লিখেছেন, চারটি সাময়িকী যথা সাধনা, বঙ্গদর্শন, ভারতী এবং তত্ত্ববোধনি সম্পাদনা করেছেন। ভারতী সাময়িকীটি এখন সম্পাদনা করেন তাঁর ভগিনী শ্রীমতী স্বর্ণা কুমারী দেবী। তাঁর ভক্তরা মনে করেন, তিনি গভীর দার্শনিক। তিনি বোলপুরে বালকদের একটি বিদ্যালয় পরিচালনা করেন যেখানে ভিন্ন পদ্ধতিতে পড়ানো হয়। সেখানে বেশির ভাগ ক্লাস আম্রকুঞ্জে হয়। বিদ্যালয়টির নাম হলো ‘শান্তিনিকেতন’ যার অর্থ হলো ‘শান্তির আবাস।’

ড. কুমারাস্বামীর মতে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৈষ্ণব কবিদের ঘরানার অন্তর্ভুক্ত যা বহু শতাব্দী ধরে অস্তিত্ব প্রাপ্ত ছিল। অন্য ভারতীয় কবিদের চেয়ে তাঁর সুবিধা রয়েছে যে, তাঁর কবিতা ইউরোপীয় স্বাদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম। ভারতে কবিতার প্রশংসা ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক বেশি। এটি একটি ছোট সংস্কৃতির চেনাজানা গোষ্ঠীর দ্বারা বা এর জন্য লিখিত নয়; এটি প্রতিটি ছোট্ট গ্রামে প্রতিদিন উচ্চ স্বরে পড়া হয়। বিছানায় যাওয়ার আগে গ্রামবাসীরা মাটিতে বসে তাদের জাতি প্রার্থনাগুলো গানের সুর করে গায়। তাই আমি কবি ও সমাজের সম্পর্কের সঙ্গে জড়িত কয়েকটি বিষয়ে স্যার রবীন্দ্রনাথের মতামত পেতে আগ্রহী ছিলাম।

আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, তাঁর মতে কোনো কবির জীবনধারণের জন্য কী তাঁর লেখার ওপর নির্ভর করা উচিত নাকি বাঁচার জন্য অন্য কোনো উপায়ের সাহায্য নেওয়া উচিত। তিনি কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন—কবি এবং শিল্পীদের তাঁদের কাজকে সত্য করে তুলতে পর্যাপ্ত অবসর প্রয়োজন, তাঁদের ভাবনাগুলো তাঁদের কাছ থেকে নিখুঁত মনোযোগ দাবি করে। সুতরাং জীবিকার প্রয়োজনে তাঁদের নিজস্ব সৃষ্টি থেকে যেকোনো বিচ্যুতি বিপর্যয়কর। অন্যদিকে কবিদের যদি সর্বসাধারণের অনুগ্রহের ওপর নির্ভর করতে হয় যারা সর্বদা শিল্পের নতুন সৃষ্টির সেরা বিচারক নন এটিও মন্দ-তবে তা দুটির মধ্যে কম মন্দ।

এরপর জিজ্ঞেস করলাম, প্রাচ্যে পাশ্চাত্যের চেয়ে কবিতার বেশি সমাদর রয়েছে। তার কারণ কী? রবীন্দ্রনাথ উত্তরে বলেন, ‘প্রাচ্যে কবিতার প্রশংসা অধিকতর, এর সাধারণ কারণ পূর্ব দেশগুলোতে কবিতা হলো সঠিক মাধ্যম, যার মাধ্যমে মানুষের গভীর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা প্রকাশিত হয় এবং প্রচারিত হয়।

আমি বললাম, তবে এটি সত্য যে, কথাটি কিছু পশ্চিমা লেখকের কবিতার ক্ষেত্রেও খাটে। তাঁদের কবিতাতেও পূর্বের চিন্তার প্রকাশ ঘটে। সে সম্পর্কে আপনার কী মনে হয়? কবি বললেন—‘পশ্চিমের সব মহান কবিরা তাঁদের মেজাজ ও চিন্তার কিছু দিক নিয়ে পূর্বের সঙ্গে তাঁদের অনুরাগ দেখান। যেমন মহান পূর্ব কবিরা পশ্চিমাদের সঙ্গে তাঁদের অনুরাগ ব্যক্ত করেন। বৃহৎ কিছু করতে হলে সর্বজনীন হতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ওয়াল্ট হুইটম্যানের কবিতা গভীর ভাবে আমেরিকার উপলব্ধি দিয়ে লেখা। যা পূর্বের ধারণা এবং অনুভূতি দ্বারা আবদ্ধ। শেলীর ‘Hymn to Intellectual Beauty’ এবং ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রকৃতির কবিতাগুলো কী পূর্বের চেতনালব্ধ নয়?’

রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে উত্তর দিলেন—‘আমি বিশ্বাস করতে পারি না, প্রাচ্যের আত্মা এবং পাশ্চাত্যের আত্মা আলাদা। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য থাকতে পারে, যেমন এর ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে একই ব্যক্তিদের মধ্যে তা ঘটতে পারে। আমরা পূর্বে আমাদের জীবনের সব ভার ঈশ্বরের ওপর দিয়ে থাকি। যিনি সব বিস্তারের কেন্দ্র, যদিও পশ্চিমা দেশগুলোতে ঈশ্বর পরিপূরক সত্য হিসেবে আসেন বা আদৌ আসেন না।’

স্যার রবীন্দ্রনাথ আধুনিক ইউরোপীয় এবং আমেরিকার কবিতা সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত। তাই তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছি, আধুনিক পশ্চিমা কবি প্রধানত প্রাচ্যের কাছ থেকে কী শিখতে পারেন। এর উত্তরে তিনি পাশ্চাত্য কবিতাকেই সেই গুণগুলোর জন্য কৃতিত্ব দিয়েছিলেন যা প্রাচ্যের কবিরা শিখছেন।

রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘প্রাচ্যের আধুনিক কবিরা পশ্চিমের কবিদের কাছ থেকে আবেগময় প্রাণবন্ত সাহিত্যের মূল্য শিখছেন যার মধ্যে রয়েছি বিজয়ের আনন্দ, গতি এবং শক্তি। পশ্চিমের কবি প্রাচ্যের কাছ থেকে শিখতে পারেন ভক্তিপূর্ণ আনন্দের পরিপূর্ণ দর্শন, যার মধ্য আছে শান্তির গভীরতা।’

এই প্রশ্নের প্রথম অংশটির উত্তরে স্যার রবীন্দ্রনাথ কবির বিশ্বজনীনতার ইঙ্গিত দেন, যা প্রমাণ দেয় পাশ্চাত্যের চিন্তাকে ধারণ করতে তিনি প্রস্তুত। তিনি কিছু সময়ের জন্য লন্ডনের বাসিন্দা ছিলেন, যেখানে কবি ও শিল্পীদের মধ্যে তাঁর অনেক বন্ধু রয়েছে এবং তিনি সেখানে আধুনিক সাহিত্য আন্দোলনের সংস্পর্শে ছিলেন। যারা মূলত মুক্ত ছন্দে কবিতা লেখার আন্দোলন করছিলেন, যাদের ফরাসি ভাষায় বলা হয় vers libre and imagisme।

তাঁকে (রবীন্দ্রনাথ) জিজ্ঞেস করলাম, এই মুক্ত ছন্দে কবিতা লেখা ইংরেজি কবিতাকে ভারতীয় কবিতার কাছে নিয়ে যাচ্ছে নাকি দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। উত্তরে তিনি বললেন—‘আমি বিশ্বাস করি, বর্তমান যুগে বিভিন্ন সাহিত্যে একে অপরের জন্য দরজা খুলে দেওয়ায় মুক্ত ছন্দে কবিতা আন্দোলন জরুরি হয়ে পড়েছে। কঠিন ছন্দে কবিতা লেখা খুবই একচেটিয়া একটি বিষয়; গদ্য ছন্দের কবিতা অনেক বেশি উদার এবং অতিথিপরায়ণ।’

সম্ভবত রবীন্দ্রনাথই জীবিত কবিদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত। বাংলায় সবাই তাঁকে ‘রবি বাবু’ বলে ডাকেন এবং তাঁর গান ভীষণ জনপ্রিয়। উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের ভাষায়, ‘আমার জানা মতে, এখন পর্যন্ত কোনো ইংরেজ কবি রবীন্দ্রনাথের মতো উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেননি।’

মি. ইয়েটস এবং অনুরূপ উৎসাহীরা ভারতীয় কবিকে এক মহান রহস্যময় এবং আধ্যাত্মিক চিন্তার নেতা হিসেবে বিশ্বাস করেন। তবে তাঁর কাজের নিরপেক্ষ পাঠ থেকে এবং তাঁর সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে দৃশ্যমান হয়, তিনি শুধু একজন দার্শনিক অথবা ধর্মীয় নেতা নন, পশ্চিমা চিন্তার তীব্র ধারকসহ পড়ালেখা জানা অসাধারণ উজ্জীবিত একজন মানুষ।

‘সারা জীবন মানুষ জমাতে চেয়েছি’

0

সারেঙ ডেস্ক

নিজের মতো একটা জীবন কাটিয়ে গেলেন কবি হেলাল হাফিজ। তাঁর এ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। অকপট এ আলাপচারিতায় তিনি বলেছেন নিজের জীবন, কবিতা ও নারীদের নিয়ে। বলেছেন খেদ আর অপ্রাপ্তির কথাও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাহাত রাব্বানী

প্রশ্ন: তেত্রিশ বছর পর নতুন কবিতার বই বের হলো, এ আনন্দ কেমন?

হেলাল হাফিজ: আনন্দের চেয়ে ভয়ই বেশি। সব সময় এ ভয় কাজ করেছে যে বেদনাকে বলেছি কেঁদো না যদি যে জলে আগুন জ্বলের ধারেকাছে যেতে না পারে! কয়েক বছর ধরে ঘষামাজা করে প্রায় ২০০ কবিতা থেকে মাত্র ৩৪টি বাছাই করে এই বই করেছি।

হেলাল হাফিজ: হ্যাঁ। বইমেলা থেকে অনেকে বই কিনে এখানে এসে অটোগ্রাফও নিচ্ছে।

হেলাল হাফিজ: ইচ্ছে করে না, তা নয়। ইচ্ছে করে। কিন্তু শরীর তো খুব নাজুক।

প্রশ্ন: শরীরের এই নাজুক অবস্থার জন্য আপনি নিজেও কি দায়ী নন?

হেলাল হাফিজ: (মুচকি হাসি।)

প্রশ্ন: আচ্ছা, বেদনাকে বলেছি কেঁদো না প্রসঙ্গে ছিলাম। ছোট ছোট সব কবিতা বইয়ে। এর কারণ কী?

হেলাল হাফিজ: স্মার্টফোনের নেশা বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নেশা। মানুষ বড় ব্যস্ত। কারও কোনো সময় নেই বই পড়ার। এই বই পড়তে বিশ মিনিটের বেশি সময় লাগবে না। এ–ই ছিল একটা ভাবনা।

হেলাল হাফিজ: একটু খেয়াল করে দেখো, আমরা একটা অস্থির সময় পার করছি, একটা আকাল…

প্রশ্ন: জীবনানন্দের কবিতার লাইনের মতো?

হেলাল হাফিজ: কোন লাইন?

প্রশ্ন: যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আস্ফালন নেই, পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

হেলাল হাফিজ: হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। এই ভাবনাই কাজ করেছে। নষ্ট-ভ্রষ্ট সময়ে দাঁড়িয়ে আমি প্রেমের কথা বলেছি, বিরহের কথা বলেছি। প্রেমও প্রতিবাদের ভাষা। প্রেম দিয়েই অনেক কিছু জয় করা যায়।

প্রশ্ন: এই কবিতাগুলো তো কবিতা ৭১–এ–ও ছিল!

হেলাল হাফিজ: সব কটা ছিল না। কিছু ছিল। ওটা তো আমার মৌলিক গ্রন্থ নয়। তা ছাড়া কবিতাগুলোর আলাদা শিরোনামও ছিল না। অচল প্রেমের পদ্য শিরোনামে ধারাবাহিক লেখা ছিল।

এখন মন তো চায়, কেউ একজন থাকুক। সারা দিন প্রেসক্লাবে কতজন দেখা করতে আসে, এভাবে দিন কেটে যায়। প্রেসক্লাব আমার সেকেন্ড হোম নেই আর, ফার্স্ট হোম। কিন্তু রাতে যখন হোটেলে যাই, মনে হয় কেউ একজন যদি থাকত অন্তত কথা বলার জন্য। শারীরিক কারণে নয়, মানসিক কারণেই মনে হয়, একজন সঙ্গী থাকা দরকার ছিল।

—হেলাল হাফিজ

প্রশ্ন: এই বইয়ের অধিকাংশ কবিতাই তো মানুষের জানা—

হেলাল হাফিজ: তুমি তো আমার কবিতা পড়েছ। তুমি তো ‘বুকের দোকান’ কবিতাটি আগে পড়োনি। এই কবিতা সম্ভবত সত্তরের দশকে লেখা। তখন নিউমার্কেটে তুমুল আড্ডা দিই। সে সময় তো খোলামেলা পোশাক তেমন ছিল না। কিছু কাপড়ের দোকানে ব্লাউজ ঝুলিয়ে রাখত, যা ভালো করে দেখলে অবিকল নারীর দেহ মনে হতো। বয়সই ছিল উসকানি দেওয়ার মতো। এই কবিতা তখন লেখা।

প্রশ্ন: তবে এত দিন পেলাম না কেন?

হেলাল হাফিজ: আমিই ভুলে গিয়েছিলাম এ কবিতার কথা। কয়েক মাস আগে পেলাম। তা–ও একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে। এই বইয়ে কিন্তু আমার আব্বার লেখাও আছে।

প্রশ্ন: এটা কীভাবে?

হেলাল হাফিজ: আমার আব্বা কবি ছিলেন। কবিতা লিখতেন। একবার এক চিঠিতে কবিতাটি লিখেছিলেন—‘রেটিনার লোনাজলে তোমার সাঁতার/ পিতৃদত্ত সে মহান উত্তরাধিকার।’ আব্বা এই লাইন কটি লিখে আরও লিখেছিলেন, ‘এই বেদনা তুমি লালন করবে এবং চেষ্টা করবে এই বেদনাকে শিল্পে রূপান্তর করতে।’ আব্বাকে সম্মান জানিয়ে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে কবিতাটি রেখেছি। নাম দিয়েছি ‘পিতার পত্র’।

প্রশ্ন: এই সব কারণে কি একাই থেকে গেলেন? জীবনের এই সময়ে এসে কী মনে হয়?

হেলাল হাফিজ: এখন মন তো চায়, কেউ একজন থাকুক। সারা দিন প্রেসক্লাবে কতজন দেখা করতে আসে, এভাবে দিন কেটে যায়। প্রেসক্লাব আমার সেকেন্ড হোম নেই আর, ফার্স্ট হোম। কিন্তু রাতে যখন হোটেলে যাই, মনে হয় কেউ একজন যদি থাকত অন্তত কথা বলার জন্য। শারীরিক কারণে নয়, মানসিক কারণেই মনে হয়, একজন সঙ্গী থাকা দরকার ছিল।

হেলাল হাফিজ: জুয়ার ভাগ্যও কিন্তু চমৎকার। তবে আমি জুয়া খেলতাম জীবিকার প্রয়োজনে। অনেক দিন এই জুয়াই ছিল আমার উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম।

প্রশ্ন: আমরা আপনার নারীভাগ্য নিয়ে কথা শুরু করেছিলাম…

হেলাল হাফিজ: সবকিছু এই কবিতার কারণেই। আমি তো পরিণত যৌবনে জিগেলো ছিলাম। পয়সাওয়ালা নারীরা টাকার বিনিময়ে আমাকে নিয়ে যেত। এমনটা তো সচরাচর আমাদের এই সমাজব্যবস্থায় হয় না।

প্রশ্ন: তা তো বটেই। এই নারীরা কি কবিতায় কোনো প্রভাব ফেলেছে?

হেলাল হাফিজ: কারা? যারা আমাকে ভাড়া নিয়ে যেত?

প্রশ্ন:  হ্যাঁ…

হেলাল হাফিজ: সবাই-ই তো কিছু না কিছু প্রভাব রেখে যায়৷ যে জলে আগুন জ্বলের কবিতাগুলোতেও অনেক নারীর উপস্থিতি আছে।

হেলাল হাফিজ: আরেকজনের নাম আছে—রানা। ‘অন্যরকম সংসার’ কবিতায় আছে দেখো, ‘এবার রানা তোমায় নিয়ে আবার আমি যুদ্ধে যাব।’

প্রশ্ন: রানা কে?

হেলাল হাফিজ: আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গী। পুরো নাম রানা মল্লিক। হিস্ট্রিতে পড়ত। ওর বড় বোন পড়ত ফিজিকসে। আলো করা সুন্দর ছিল ওরা৷ পথে যখন ওরা হাঁটত, সবাই তাকিয়ে থাকত ওদের দিকে, এমন সুন্দর ছিল।

প্রশ্ন: সবিতা সম্পর্কে তো আগে থেকেই জানা আছে আমাদের…

হেলাল হাফিজ: তিনি তো আমার ১২ বছরের বড়। কোনো সুন্দরী মহিলাকে দেখলেই মনে হয়, ইস ইনি যদি আমার মা হতেন! সবিতা সেন তেমন। যার সঙ্গে শারীরিক উদ্দীপনার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তার অমিত লাবণ্য আমাকে কল্পনায় অনুপ্রাণিত করত।

যৌবনে হেলাল হাফিজ
যৌবনে হেলাল হাফিজছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন: হেলেন তো আপনার প্রেমিকা ছিলেন!

হেলাল হাফিজ: হেলেন আমার প্রায় সমবয়সী ছিল। আমি ওর প্রেমে পড়েছিলাম। হেলেন কিন্তু আহামরি সুন্দরী ছিল না, সুন্দরী ছিল ওর মা।

হেলাল হাফিজ: হিরণবালা একদম আলাদা। তার নামেই রচিত হয়েছে একটি কবিতা। হিরণবালা পেশায় সেবিকা ছিলেন। ১৯৬৯ সালের গণ–অভ্যুত্থানের সময় ক্লাস বন্ধ থাকায় নেত্রকোনায় চলে যাই কয়েক দিনের জন্য। গিয়েই ওখানকার বন্ধুদের মুখে শুনি, এক জাঁদরেল নার্স এসেছে। পরিচয় হলেও তেমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি সেবার। একটা চুমু পর্যন্তও খেতে পারিনি। ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে পরেরবার। প্রায় ২০ দিনের ছুটি। যৌবনের তৃষ্ণাকাতর মন ও জীবন মুক্তি পেল। হিরণবালা কিন্তু বিবাহিত ছিলেন। ওর স্বামীর সঙ্গে বসেও আড্ডা দিয়েছি। কবি হিসেবে ঢাকায় তখন আমার পরিচয় আছে, সে জন্য কদর একটু বেশি। গণ–অভ্যুত্থানের পর আমি ঢাকায় ফিরি। হিরণবালার কর্মস্থলের পরিবর্তন হয় এরপর। তারপর যোগাযোগ হয়নি আর।

প্রশ্ন: আর তনা?

হেলাল হাফিজ: তসলিমা, তসলিমা নাসরিন। আমার ‘ব্রহ্মপুত্রের মেয়ে’ কবিতাও তসলিমাকে নিয়ে লেখা। এদের বাইরে আরও একজন আমার কবিতায় মিশে আছেন, তিনি রেণু আপা।

প্রশ্ন: এই নাম ঠিক খেয়াল হচ্ছে না…

হেলাল হাফিজ: সবিতা, হেলেন, হিরণবালার নাম সরাসরি কবিতায় এসেছে। তাদের কথা তোমার জানা। কিন্তু এর বাইরেও একজন নারী আছেন, যাঁর নাম সরাসরি কোনো কবিতায় নেই।

প্রশ্ন: রেণু আপা! তিনি কে ছিলেন?

হেলাল হাফিজ: হ্যাঁ, তিনি রেণু আপা। তিনি আমাকে সাংঘাতিক প্রভাবিত করেছেন। রেণু আপা ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী। বিদুষী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী। আমি মগ্ন ছিলাম তাঁর অবিমিশ্র প্রেমে। আমি মুন্সিগঞ্জে চাকরি করেছি বাবার সঙ্গে অভিমান করে, তা তো তুমি জানোই। তখন রেণু আপাকে ঘিরে ভালোবাসা গাঢ় হয়। রেণু আপা তখন চাঁদপুরে। আমার ফুফা মানে রেণু আপার বাবা তখন মুন্সিগঞ্জে। প্রথম সেখানেই থাকতাম। রেণু আপা রোববারে আসতেন। সোমবারে চলে যেতেন। তাঁকে লঞ্চে তুলে দিতে যেতাম আমি। ঘাট থেকে লঞ্চ ছেড়ে দিত, আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমার চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়ত। এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। কেবল অনুভূতি। তখনকার রক্ষণশীল পরিবারের জন্য তাঁকে কিছু বলতে পারিনি। তিনি তো ছিলেন আমার চেয়ে ১২–১৩ বছরের বড়। আমার ‘প্রতিমা’, ‘ইচ্ছে ছিল’—এসব কবিতা তাঁকে নিয়ে লেখা।

হেলাল হাফিজ: আমার সমসাময়িক কবিদের মধ্যে আবুল হাসানকেই আমি একমাত্র ঈর্ষা করি। এই ঈর্ষা নোংরা নয়, শৈল্পিক। যেকোনো শিল্পীর এই ঈর্ষা থাকতে হবে।

প্রশ্ন: এই সময়ে এসে কোনো অপ্রাপ্তির কথা মনে পড়ে?

হেলাল হাফিজ: মাতৃস্নেহ। এই একটা অপ্রাপ্তিই আমার। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার মা মারা যান। তাঁর কোনো স্মৃতি নেই আমার। এ ছাড়া কোনো অপ্রাপ্তি দেখি না। আমি আমার যোগ্যতার চেয়ে অনেক বেশি আদর পেয়েছি। এই সবই আমার সঞ্চয়। সারা জীবন মানুষ জমাতে চেয়েছি। সবাই জমায় টাকা, আমি চাই মানুষ জমাতে।

প্রশ্ন: অনেকক্ষণ ধরে গল্প করলাম। আরেকটা বিষয় জানতে চাই।

হেলাল হাফিজ: বলো।

প্রশ্ন: কবিতার আরও বই করার ইচ্ছা আছে?

হেলাল: আরেকটি কবিতার বই করতে চাই। দেখি কতদূর পারি। আলস্য তো আমার নারীর চেয়েও প্রিয়৷ তা ছাড়া আমার আত্মজীবনীটা লিখতে চাই।

হেলাল হাফিজ : শুরু করেছি। কিছু অংশ লেখা হয়েছেও। কিন্তু শরীর খুব একটা সায় দিচ্ছে না। বাঁ–চোখে তো দেখি না একদম।

কবি নজরুল জুলাই বিপ্লবের চেতনার বাতিঘর : শিকদার

0

সারেঙ ডেস্ক

নজরুল ইনস্টিটিউটের সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বিশিষ্ট কবি আবদুল হাই শিকদার বলেছেন, কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সত্যিকার অর্থেই জুলাই বিপ্লবী চেতনার বাতিঘর। জুলাই বিপ্লবের প্রতিটি উচ্চারণে তাই কবি নজরুলের লেখা অনিবার্য বিপ্লবের প্রতীক হয়ে স্লোগান দেয়াল লিখনসহ প্রতিটি কর্মে প্রতিফলিত হয়েছে।

বৃহস্পতিবার নগরীর রংপুর পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে স্থাপিত ‘চির উন্নত মম শির’ শিরোনামের নান্দনিক ডিজাইনে নির্মিত ‘স্বাধীনতা স্কয়ার’-এর ফলক উন্মোচন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে শিকদার এ কথা বলেন।

জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান, কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধের প্রাসঙ্গিকতার ভাবনার আলোকে নতুন প্রজন্মের কাছে কাজী নজরুল ইসলামের চেতনা তুলে ধরতে রংপুর পুলিশ লাইন স্কুল এন্ড কলেজ মাঠে ‘চির উন্নত মম শির স্বাধীনতা স্কয়ার’ স্থাপন করা হয়েছে। রংপুর পুলিশ লাইন স্কুল এন্ড কলেজের একাডেমিক বিল্ডিংয়ের উত্তর-পশ্চিম কর্নারে শহিদ মিনারের পাশে স্থাপন করা হয়েছে নান্দনিক ডিজাইনের এই স্বাধীনতা স্কয়ার। মার্বেল পাথর ও টাইলসে সুশোভিত করা হয়েছে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ম্যুরাল।

বহুমাত্রিক লেখক ও নজরুল বিশেষজ্ঞ শিকদার, নজরুলের চেতনা শোষণের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশের জন্য নজরুল সবসময়ই প্রাসঙ্গিক। মানবাধিকার ফিরিয়ে আনতে, আইনের শাসন, নারীর স্বাধীনতা বা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার নতুন সংগ্রামের পথে নজরুল আমাদের অনিবার্য প্রেরণা। জুলাই বিপ্লবের প্রতিটি উচ্চারণে, পোস্টার স্লোগানে নজরুলের সেই বৈপ্লবিক চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে।’

কবি আবদুল হাই শিকদার সাংবাদিকদের কাছে নতুন প্রজন্মের কাছে কবি নজরুলকে তুলে ধরতে স্বাধীনতা স্কোয়ার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ায় বাংলাদেশ পুলিশ এবং রংপুর পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে কবি কাজী নজরুল ইসলামের বহুমাত্রিক প্রাসঙ্গিকতা নতুন প্রজন্মের কাছে আলোড়িত ও জাগ্রত হবে। বৈষম্যহীন সমাজ ও জাতি গঠনের আকাঙ্খা বাস্তবায়িত হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

পরে পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ মিলনায়তনে ‘শাশ্বত নজরুল: সমকালীন সময়ে সংগ্রাম’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আবদুল হাই শিকদার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ পুলিশের রংপুর রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক আমিনুল ইসলাম।

অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শরীফ উদ্দিন, রংপুর পুলিশ লাইন স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. কে এম জালাল উদ্দিন আকবর, কুড়িগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম, কারমাইকেল কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মিজানুর রহমান, কুড়িগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের উপাধ্যক্ষ, পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ (একাডেমিক) মো জাহাঙ্গীর আলম, রংপুর পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের উপাধ্যক্ষ গোলাম জাকারিয়া, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের রংপুর মহানগর আহ্বায়ক ইমতিয়াজ আহমেদ ইমতি প্রমুখ।

আবদুর রহমান মল্লিকের কবিতা

0

নাজনিন নাহারের কবিতা

0

কবি আসাদ চৗধুরী ও তাঁর কিছু অনবদ্য কবিতা

0

জাহানারা হক

সন্দেহ নেই যে আসাদ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের একজন শক্তিমান কবি। ব্যক্তি আসাদ চৌধুরী আর তাঁর কবিতা উভয়ই আমাদের চমৎকৃত করে। তাঁকে দেখলেই মনে হতো-কবিরাতো এমনই হয়। তিনি যেমন তাঁর কবিতাও তেমন। তাঁকে আর তাঁর কবিতার মাঝে কোনো অসঙ্গতি চোখে পড়ে না। পাহাড়ের ঝরনার মতো উচ্ছ্বল তাঁর কবিতা। যে জলের ঝাপটায় আমরা সিক্ত হই, পুলকিত হই, রোমাঞ্চিত হই।

আসাদ চৌধুরীর কবি মানস গঠন হয়েছিল কিশোর বয়স থেকেই। তখন থেকেই তিনি কবি নজরুল পড়তেন। গোয়েন্দা কাহিনির প্রতি ছিল তাঁর প্রবল ঝোঁক। কবির জন্মভূমি বলেই যেন উলানিয়া গ্রামটি সবার কাছে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। বরিশাল বিভাগের বাকেরগঞ্জ জেলার মেহেদীগঞ্জ উপজেলায় উলানিয়া জমিদার বাড়িতে কবির জন্ম
১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে ১১ ফেব্রুয়ারি। বাবা আরিফ চৌধুরী আর মা সৈয়দা মাহমুদা বেগম। কবির জন্মের পর জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পথে ছিল তাই জমিদারির জৌলুস কবিকে তেমনভাবে ভোগবিলাসী করে তুলতে পারেনি। ১৯৫৭ সালে তিনি উলানিয়া হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা উত্তীর্ণ হন। কবি ১৯৬০ সালে এইচএসসি পাস করেন ব্রজমোহন কলেজ থেকে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন । ১৯৬৩ সালে তিনি স্নাতক ও ১৯৬৪ সালে তিনি স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

ঢাকায় আসার পর মোহাম্মদী পত্রিকার প্রুফরিডার আবু জাফর চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর আড্ডা ঘোরাঘুরি চলত। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হবার সুবাদে বিভিন্ন সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হন। মুনীর চৌধুরী, মুহম্মদ আব্দুল হাই, নীলিমা ইব্রাহীম প্রমুখ গুণীজন ও শিক্ষকদের সাহচার্যে আসেন তিনি। নীলিমা ইব্রাহীম কবিকে ‘অসুখ’ বলে ডাকতেন। রফিক আজাদ আসাদুল ইসলাম থেকে আসাদ চৌধুরী নাম দেন তাঁর। ডি-৩১ ঢাকা হলে তিনি থাকতেন। সেই সময়ে বিভিন্ন হলে নাটক হতো আর তিনি নিয়মিত তা দেখতেন। আব্দুল্লাহ আল মামুন, আতাউর রহমান প্রমুখের নির্দেশনায় তখন নাটক হতো ।

রফিবুল ইসলাম স্যার সেই সময়ে আধুনিক কবিতার ক্লাস নিতেন এবং তাঁর মাধ্যমেই কবির প্রথম দুটি কবিতা ছাপা হয়। মুহম্মদ আব্দুল হাই তখন বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন। বাংলা ডিপার্টমেন্টের সাহিত্য সপ্তাহ উদযাপন তখন উল্লেখযোগ্য ছিল। ৬১ সালে রবীন্দ্রজয়ন্তী শতবর্ষ পালিত হয়। এটি সেই সময় সাহিত্য অঙ্গণে খুব গুরুত্ব পায়। কবি আসাদ চৌধুরী ৬৩ সালে সাহিত্য সংস্কৃতি সপ্তাহের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
কবির কর্মজীবন শুরু হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে শুরু হয়। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি শিক্ষকতা করেন। তারপর তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। ৭৩ সালে বাংলা একাডেমিতে যোগ দেন এবং পরিচালক হিসেবে অবসর নেন। ৮৫ থেকে ৮৮ সাল পর্যন্ত তিনি ভয়েস অব জার্মানি বাংলাদেশ এ সাংবাদিকতা করেন।

কবির বিনোদনের একমাত্র অবলম্বল ছিল বই। তাঁর প্রথম কবিতা পেত্রিস লুমুুম্বা। প্রথম কাব্য তবক দেয়া পান। গণমানুষের মুক্তি তাঁর কবিতার মূল সুর। শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের জয়গান গেয়েছেন তিনি। তাঁর বিভিন্ন কবিতায় সমাজের দেশের জাতির অসুন্দর থেকে মুক্তি এবং সুন্দরের আকুতি ছিল কবিতায় পরতে পরতে। তাঁর ধারণা কৃষিভিত্তিক সমাজে ঠকানোর মানসিকতা থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি হয়। ধর্মীয় ক্ষেত্রে, স্বাধীনতার নামে, সংস্কৃতির নামে শোষণ চলত। তিনি বলতেন যুদ্ধ করার জন্য মানুষ পাগল না তেমন। কিন্তু যুদ্ধাস্ত্র কেনার জন্য পাগল। ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ তাঁর কবিতায় পেয়েছে ভিন্নমাত্রা। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যে বঞ্চিত হচ্ছে তা ভাষার ক্ষেত্রে প্রথম দেখা যায়। মানুষ রাজনীতি সচেতন হয়নি কিন্তু দলবাজি করতে শিখেছে।

সত্যানুসন্ধিৎসু কবি সত্যের সাধানাই করে গেছেন আজীবন। কারণ জীবন থেকে সত্য চলে গেলে জীবন মহিমা হারায়। তাই কপট সমাজের চিত্র দেখে তিনি মর্মাহত ছিলেন। সেই ক্ষেদোক্তি তাঁর কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে। ‘সত্য ফেরারী’ কবিতায় আমরা তাঁর প্রকাশ লক্ষ করি।

কোথায় পালালো সত্য?
দুধের বোতলে, ভাতের হাড়িতে! নেই তো
রেস্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে,
গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে,
টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে,
নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো।

শুধু তাই নয়, স্রোতে গাঁ না ভাসিয়ে খুব বিনয়ের সাথে তিনি নিজের অবস্থান তুলে ধরেছেন। আশ পাশের মানুষের দৃষ্টির উদাসীনতাকে তিনি কটাক্ষ করেছেন। কায়দা করে পাশ কাটিয়ে কোনো কিছু ইনিয়ে বিনিয়ে বলবার মানুষ তিনি নন। তাই ‘বলার জন্য বলা’ কবিতায় তিনি তাঁর সংগ্রামী চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। শোষকের দিকে ছুড়ে মেরেছেন তাঁর দ্রোহের কবিতা।

মানুষ, আমি কোনোদিন তোমাদের কাছে
মেঘের হিসেব চাইনি।
আমিওতো বলতে পারতাম
তোমাদের আঘাতে এবং দারুণ অবহেলায়
এই যে জোৎস্না অকারণ টুপ টুপ করে ঝড়ে গেল
তোমাদের দৃষ্টির এই উদাসীনতা কেন?
বলিনি !
কেননা তোমরা তখন ধান্ধায় মেতে আছো
মানুষ আর পাতার আন্দোলন
আমিতো মেনেই নিয়েছি।
আমিওতো আমার দুর্বল এবং প্রায় ব্যক্তিগত লেখাগুলো
এক সময় উদ্ধত শোষকের দিকে
সজোরে ছুড়ে দিয়েছিলাম যতটুকু সাধ ছিল।
দেইনি?

একজন কবির সত্তায় দেশপ্রেম কতটা জাগ্রত থাকলে তিনি বলতে পারেন।
নদীর জলে আগুন ছিল
আগুন ছিল বৃষ্টিতে
আগুন ছিল বীরাঙ্গনার উদাস করা দৃষ্টিতে।
[ তখন সত্যি মানুষ ছিলাম]

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি ভূমিকা ছিল কবির। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এসেছে বারবারাকে প্রশ্নের ভেতর দিয়ে।
আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে বারবারা
তোমাদের কাগজে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খাঁর ছবি ছাপা হয়-
বিবেকের বোতামগুলো খুলে হৃদয় দিয়ে দেখো
ওটা একটা জল্লাদের ছবি
পনেরো লক্ষ নিরস্ত্র লোককে ঠান্ডা মাথায় সে হত্যা করেছে
মানুষের কষ্টার্জিত সভ্যতাকে সে গলা টিপে হত্যা করেছে
অদ্ভুত জাদুকরকে দেখ
বিংশ শতাব্দীকে সে কৌশলে টেনে হিঁচড়ে মধ্যযুগে নিয়ে যায়।

চিরাচরিত কোনো নীতিকথা শুনিয়ে কবি থেমে যান নি। তিনি প্রবল পরাক্রমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আহবান জানিয়েছেন। যে সংগ্রামী চেতনা কবিকে মুক্তিসংগ্রামে অবতীর্ণ করেছিল। সেই চেতনায় আমাদের সভ্যতা, দর্শন সাহিত্যকে তিনি সুরক্ষা দেবার আহবান জানিয়েছেন-

বারবারা এসো,
রবিশঙ্করের সুরে সুরে মুমূর্ষু মানবতাকে গাই
বিবেকের জংধরা দরোজায় প্রবল করাঘাত করি
অন্যায়ের বিপুল হিমালয় দেখে এসে ক্রুদ্ধ হই, সংগঠিত হই
জল্লাদের শাণিত অস্ত্র
সভ্যতার নির্মল পুষ্পকে আহত করার পূর্বে,
দর্শন ও সাহিত্যকে হত্যা করার পূর্বে
এসো বারবারা বজ্র হয়ে বিদ্ধ করি তাকে।

কবি আসাদ চৌধুরী পেত্রিস লুমুম্বা কবিতায় কঙ্গোর মহান নেতাকে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা নির্মমভাবে হত্যা করে। কবি এ নেতার হত্যাকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। রনেশ দাস গুপ্ত সংবাদের এডিটোরিয়াল পৃষ্ঠায় ‘পেত্রিস লুমুম্বা’ কবিতাটি ছাপান। মানুষ এতো নিষ্ঠুর হতে পারে এ চেতনা থেকেই কবিতার সৃষ্টি।
কবি আসাদ চৌধুরীর কবিতা শুনলে বা পাঠ করলে হৃদয়ের তন্ত্রীগুলো উজ্জীবিত হয়। তিনি দ্রোহ আর সুন্দরকে ধারণ করেছেন তাঁর লেখাগুলোতে। শোষণ শাসনের বেড়াজাল থেকে মুক্তিকামী মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনার স্বপ্ন দেখেছেন। আমরা তাঁর স্বপ্নকে ধারণ করবো এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌছে দেবার অঙ্গীকার করবো। চির সবুজ চির তরুন কবিকে আমরা মনে রাখবো। তিনি চেয়েছেন আমরা যেন লোভে ও উদ্ধত খড়গের ভয়ে আপোষ করে সত্যভ্রষ্ট না হই। তিনি জনপ্রিয় হতে চাননি। তিনি প্রিয় হয়ে আছেন। তিনি চলে যাননি। সবার হৃদয়ে আছেন।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভালুম আতাউর রহমান খান ডিগ্রি কলেজ, ধামরাই, ঢাকা।