মধুসূদনকে ভুলি কেমনে?

0
17

গোলাম কবির

যশোরের সাগরদাড়িতে অবস্থানকালে ছেলেবেলায় বিভিন্ন পণ্ডিতের কাছে রামায়ণ-মহাভারত ও অন্যান্য প্রচলিত বাংলা বই মধুসূদন পড়েছিলেন। জননী জাহ্নবী দেবী ছেলেকে গড়ে তোলার ব্যাপারে কোনো কার্পণ্য করেননি। আরবি-ফারসির সঙ্গে তখনই তাঁর পরিচয় হয়। কলকাতায় এসে মেধাবী মধুসূদন ইংরেজি পাঠে এত বেশি মশগুল হয়েছিলেন যে একলাফে বায়রন হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখেন।

মাদ্রাজে গিয়ে তিনি পত্রপত্রিকায় ইংরেজি চর্চা করে খ্যাতি অর্জন করেন। এখানেই শেষ নয়, দুটি কাব্যও রচনা করেন ইংরেজিতে। ‘ক্যাপটিড লেডি’ এবং প্রথম কাব্যটি সাধারণ ছন্দে লেখা হলেও দ্বিতীয় কাব্য ‘ভিশনস অব দ্য পাস্ট’ অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা। অনেকে মনে করেন, এটি কবি বায়রনের ‘ড্রিম’ শীর্ষক কবিতা স্মরণ করিয়ে দেয়।

 

ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য ইউরোপযাত্রার প্রাক্কালে জন্মভূমিকে স্মরণ করে একটি কবিতা লেখেন, ‘রেখো, মা, দাসেরে মনে!/সাধিতে মনের সাধ, যদি ঘটে পরস্বাদ মধুহীন করো না গো তব মন’

না, মধুসূদনকে আমরা ভুলিনি।

ইউরোপে গিয়ে ১৮৬২ থেকে ১৮৬৩ পর্যন্ত ভার্সাই নগরীতে অবস্থানকালে অমিত্রাক্ষর ছন্দে ১০০টি ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। অবশ্য পরবর্তী সংস্করণে আরো সাতটি কবিতা সংযুক্ত করে ১০৭টি চতুর্দশপদী কবিতার সংকলন প্রকাশ করা হয়। এই কবিতাগুলোতে তাঁর আত্মজীবনের বেশ কিছু অংশ সংযোজিত হয়েছে। এই যে ইংরেজি রচনা থেকে বাংলায় পদার্পণের কথা আবেগমথিত কণ্ঠে উচ্চারণ করেন : ‘হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন’—কবিতাটি পড়লে বোঝা যাবে, তিনি কোন বেদনার রসে আপ্লুত হয়ে মাতৃভাষায় কবিতা রচনায় ব্যাপৃত হন। এ কাব্যেই স্মরণ করেছেন তাঁর প্রিয় মানুষগুলোকে, তাঁরা দেশে-বিদেশে বিস্তৃত। ‘আত্মবিলাপ’ কবিতায় কবি তাঁর দগ্ধ হৃদয়ের কথা প্রকাশ করতে গিয়ে লিখেছেন : ‘আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিলু, হায়, তাই ভাবি রবে?’

১৮৬২ থেকে ১৮৭৩—এই ১২টি বছর মধুসূদন বাংলা সাহিত্য সাধনা করেন। এর মধ্যে নানা কষ্টে দিনাতিপাত করে তিনি যেসব কীর্তি রেখে গেছেন, তা সাধারণের পক্ষে বিস্ময়কর।

মধুসূদনের অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য দিয়েই আমরা  গর্ব করি। এ ছাড়া সনেট, আধুনিক জীবনঘনিষ্ঠ নাটক ‘প্রহসন’, তার তুলনা হয় না। মৃত্যুশয্যায় লিখেছিলেন ‘হেক্টর বধ’ নামের একটি মহাকাব্যাংশ। ২৯ জুন ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে দুপুর ২টার সময় আলিপুর দাতব্য চিকিৎসালয়ে তিনি মানবলীলা সংবরণ করেন।

মৃত্যুর আগে তিনি একটি এপিটাফ লিখেছিলেন, ‘দাঁড়াও পথিক জন্ম যদি তব বঙ্গে’। এপিটাফ নয়, তবে ঠিক এই রকমের হৃদয়ঝংকার ধ্বনিত হয়েছিল কবি ইমরুল কায়েসের সেরা কাব্য ‘মোয়াল্লাকা’র প্রথম—‘কেফা নাবকি মিন জেকরা হাবিবেও ওয়া মানজেলি’। প্রিয়া আর তার বাসস্থান স্মরণ করে একটু দাঁড়াও। আর মধুসূদন জন্ম যদি বঙ্গে হয়, তবে তাঁকে দাঁড়াতে বলেছেন। দাঁড়াতে বলার বিশেষত্ব হলো আমরা যেন কবির সুখ-দুঃখের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে অবহিত হই। আমরা কতটুকু সার্থক হয়েছি জানি না, ধর্মবোধের অবকাঠামোতে কবির কীর্তিকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। পঠন-পাঠনক্ষেত্রেও সেই একই অবহেলা। রবীন্দ্রনাথ বালকবেলায় সম্পূর্ণ ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য পড়েছেন, যুবকবেলায় আমরা এই কাব্যের একটি পর্ব পাঠ্য তালিকায় রেখে দায় সারছি। ওই যে বিলেত যাওয়ার প্রাক্কালে বললেন, ‘রেখো মা দাসেরে মনে’, অথবা ‘দাঁড়াও পথিক বর’ ইত্যাদি ভাবনায় কবির যে আকুতি প্রকাশ পেয়েছে, আমরা তারও মূল্য দিইনি।

১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যে কবি নারী স্বাধীনতা সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টি উম্মীলন করেন। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ‘তিলোত্তমা সম্ভব’ কাব্য, ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য কিংবা বহু কবিতায় কবি নারীকে জননীর স্থানে রেখে যেসব বাণী দিয়ে গেছেন, তা আজও আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে।

আমরা মধুসূদনের কবিত্বকে অভিনবত্বের কথা বলেছি। এটা সত্য যে ইউরোপীয় নাটকের ছায়া অবলম্বনে কোনো নাটক বাংলা সাহিত্যে আসেনি। মধুসূদন প্রথম পাশ্চাত্য পাঠকের অনুকরণে নাটক লেখা শুরু করলেন, যেখানে আত্মজীবনের ছায়া আছে বলে অনেকে মনে করেন। তবে ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ আর ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ প্রহসনে শুধু নতুন বিষয় নয়, ভাষার নতুনত্ব আমাদের চমত্কৃত করে। বাংলায় বর্ণিত গদ্যের ইতিহাসে তার উল্লেখযোগ্য সন্ধান পাই না। আমাদের অনেক দুঃখের মধ্যে মধুসূদনের যথার্থ মূল্যায়ন না হওয়া আমাদের জাতীয় দুর্বলতার স্বাক্ষর।

(সদ্যঃপ্রয়াত অধ্যাপক গোলাম কবিরের অপ্রকাশিত নিবন্ধ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here