আনোয়ারা সৈয়দ হকের ‘বাসিত জীবন’

গ্রন্থ আলোচনা

0
27

সারেঙ ডেস্ক

যে বইয়ের পাতার পর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ভাবছি এই বুঝি শেষ জীবনের কিনার! মন অদ্ভুত বিষাদে ভরে উঠছে। ভাবছি পাখায় পাখায় এত এত রং নিয়ে, এত ওড়াওড়ি শেষে জীবন ফুরিয়ে কোথায় গেলেন কবি? সেই বইয়ের নাম ‘বাসিত জীবন’। যে জীবন নদী, ঝরনা আর পাহাড়ের মতো সব্যসাচি লেখক সৈয়দ শামসুল হক আর আনোয়ারা সৈয়দ হক হয়ে বয়ে গেছেন ওতপ্রোতভাবে একই সমান্তরালে।

আপাদমস্তক যিনি লেখক, সাহিত্যকে ভালোবেসেছেন প্রাণপণে, শয়নে-স্বপনে কেবল লেখার কথাই ভেবেছেন, এমনকি নিশ্চিত মৃত্যু এগিয়ে আসছে জেনেও লিখে গেছেন মরিয়া হয়ে মৃত্যুকে প্রতীক্ষায় বসিয়ে—তিনি সৈয়দ শামসুল হক। যিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন ‘যেকোনো যুদ্ধে হেরে গেলেই আমরা সাধারণ হয়ে যাই। হতে পারে সেটা জীবনযুদ্ধ বা সত্যিকারের কোনো যুদ্ধ।’ সেই মানুষটির গোটা জীবন নিয়ে তিনি নিজেই একটা উপন্যাস।

সৈয়দ শামসুল হক চিরদিন স্রোতোধারা হয়ে বইবেন বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে। সৈয়দ হকের সঙ্গে কাটানো শেষ দিনগুলোর কথা আনোয়ারা সৈয়দ হকের ‘বাসিত জীবন’ বইটিতে পাই অনেকটা দিনপঞ্জির মতো করে। চিরচেনা সৈয়দ হককে অন্য আলোয় দেখার সুযোগ করে দিলেন ‘হেমিংওয়ে’র সহযাত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হক।

২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাস বাড়ির কুকুর ভুলু ওরফে পেরির প্রতিরাতের কান্না দিয়ে বইটির শুরু। লেখা এগোতে থাকে ৮০তম জন্মবার্ষিকীতে সন্মাননা গ্রন্থ বের করার প্রস্তুতি থেকে মোড়ক উন্মোচনের দিনের দিকে। মাঝে কবিতা পরিষদের সৈয়দ হকের জন্মদিন উদযাপনের বর্ণনা ও লেখকের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও মনোজগতের নানা ভাবনার পথ অতিক্রম করে। অনেকটা সময় এগিয়ে এসে ১২ এপ্রিল, ২০১৬ জানা যায় ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত সৈয়দ হক। তারপর দিন থেকে ১৫ এপ্রিল লন্ডনের ফ্লাইটে ওঠার আগে অবধি লেখকের লেখায় যেমন দম্পতির অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে, তেমনি সৈয়দ হকের শক্ত মনোবলের দেখা মেলে। আবার এমন মানুষের দেখাও মেলে যে বা যাঁরা পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আর কখনো দেখা করেন না। কিন্তু হক দম্পতি অগণিত মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন, অসংখ্য মানুষ সময়ে-অসময়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সেই গল্পও গোটা লেখায় পাই।

আনোয়ারা সৈয়দ হকের প্রখর স্মৃতিশক্তির স্বাক্ষর মেলে সেপ্টেম্বর, ২০১৬-এর দিনলিপিতে। বইয়ের শুরুতেই প্রসঙ্গ কথায় তিনি লিখেছেন, ‘৩১ আগস্ট দেশে ফিরে আসার পর পরিবেশের চাপে আর সে রকমভাবে তারিখ অনুযায়ী, আমি লিপিবদ্ধ করতে পারিনি। ফলে পুরো সেপ্টেম্বরের দৈনন্দিন ইতিহাস আমার স্মৃতি থেকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।’ কিন্তু সেপ্টেম্বরের দিনলিপি পড়তে গিয়ে এমন ছোট ছোট বিষয় চোখে পড়েছে, যেগুলো পড়তে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে তিনি শুধু সব মনে রাখেন না, আবেগহীন হয়ে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাও রাখেন, এমনকি খুব ব্যক্তিগত এবং বেদনাদায়ক বিষয়েও। ত্রিপুরায় কিনে দেওয়া সোনার পাত বসানো দুটি শাঁখাচুড়ির কথা যখন সৈয়দ হক মনে করলেন, সেই ঘটনাক্রমের সঙ্গে চুড়ি দুটি না পাওয়ার বেদনা যেভাবে জুড়ে দিলেন, তাতে কেবল হেমিংওয়ের প্রতি লেখকের অপত্য ভালোবাসাই যে ফুটে ওঠে, তা-ই নয়, সামলে নেওয়ার সুন্দর অভিব্যক্তিরও প্রকাশ ঘটে।

দুই শ চৌষট্টি পৃষ্ঠার বইটি পড়তে শুরু করলে শেষ না করে পাঠক উঠতে পারবেন না—লেখার গতি ও সুসম্পাদনা চুম্বকের মতো বইটিতে ডুবিয়ে রাখে। পাঠক যদি সৈয়দ হকপ্রেমী হন, তবে চাইলেও বইটি শেষ না করে ওঠা কঠিন; বরং অন্য কোনো কাজকে সৈয়দ হকের মতো করে বলতেই পারেন—গুলি মারো!

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here