কবি আসাদ চৗধুরী ও তাঁর কিছু অনবদ্য কবিতা

0
65

জাহানারা হক

সন্দেহ নেই যে আসাদ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের একজন শক্তিমান কবি। ব্যক্তি আসাদ চৌধুরী আর তাঁর কবিতা উভয়ই আমাদের চমৎকৃত করে। তাঁকে দেখলেই মনে হতো-কবিরাতো এমনই হয়। তিনি যেমন তাঁর কবিতাও তেমন। তাঁকে আর তাঁর কবিতার মাঝে কোনো অসঙ্গতি চোখে পড়ে না। পাহাড়ের ঝরনার মতো উচ্ছ্বল তাঁর কবিতা। যে জলের ঝাপটায় আমরা সিক্ত হই, পুলকিত হই, রোমাঞ্চিত হই।

আসাদ চৌধুরীর কবি মানস গঠন হয়েছিল কিশোর বয়স থেকেই। তখন থেকেই তিনি কবি নজরুল পড়তেন। গোয়েন্দা কাহিনির প্রতি ছিল তাঁর প্রবল ঝোঁক। কবির জন্মভূমি বলেই যেন উলানিয়া গ্রামটি সবার কাছে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। বরিশাল বিভাগের বাকেরগঞ্জ জেলার মেহেদীগঞ্জ উপজেলায় উলানিয়া জমিদার বাড়িতে কবির জন্ম
১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে ১১ ফেব্রুয়ারি। বাবা আরিফ চৌধুরী আর মা সৈয়দা মাহমুদা বেগম। কবির জন্মের পর জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পথে ছিল তাই জমিদারির জৌলুস কবিকে তেমনভাবে ভোগবিলাসী করে তুলতে পারেনি। ১৯৫৭ সালে তিনি উলানিয়া হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা উত্তীর্ণ হন। কবি ১৯৬০ সালে এইচএসসি পাস করেন ব্রজমোহন কলেজ থেকে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন । ১৯৬৩ সালে তিনি স্নাতক ও ১৯৬৪ সালে তিনি স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

ঢাকায় আসার পর মোহাম্মদী পত্রিকার প্রুফরিডার আবু জাফর চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর আড্ডা ঘোরাঘুরি চলত। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হবার সুবাদে বিভিন্ন সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হন। মুনীর চৌধুরী, মুহম্মদ আব্দুল হাই, নীলিমা ইব্রাহীম প্রমুখ গুণীজন ও শিক্ষকদের সাহচার্যে আসেন তিনি। নীলিমা ইব্রাহীম কবিকে ‘অসুখ’ বলে ডাকতেন। রফিক আজাদ আসাদুল ইসলাম থেকে আসাদ চৌধুরী নাম দেন তাঁর। ডি-৩১ ঢাকা হলে তিনি থাকতেন। সেই সময়ে বিভিন্ন হলে নাটক হতো আর তিনি নিয়মিত তা দেখতেন। আব্দুল্লাহ আল মামুন, আতাউর রহমান প্রমুখের নির্দেশনায় তখন নাটক হতো ।

রফিবুল ইসলাম স্যার সেই সময়ে আধুনিক কবিতার ক্লাস নিতেন এবং তাঁর মাধ্যমেই কবির প্রথম দুটি কবিতা ছাপা হয়। মুহম্মদ আব্দুল হাই তখন বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন। বাংলা ডিপার্টমেন্টের সাহিত্য সপ্তাহ উদযাপন তখন উল্লেখযোগ্য ছিল। ৬১ সালে রবীন্দ্রজয়ন্তী শতবর্ষ পালিত হয়। এটি সেই সময় সাহিত্য অঙ্গণে খুব গুরুত্ব পায়। কবি আসাদ চৌধুরী ৬৩ সালে সাহিত্য সংস্কৃতি সপ্তাহের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
কবির কর্মজীবন শুরু হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে শুরু হয়। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি শিক্ষকতা করেন। তারপর তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। ৭৩ সালে বাংলা একাডেমিতে যোগ দেন এবং পরিচালক হিসেবে অবসর নেন। ৮৫ থেকে ৮৮ সাল পর্যন্ত তিনি ভয়েস অব জার্মানি বাংলাদেশ এ সাংবাদিকতা করেন।

কবির বিনোদনের একমাত্র অবলম্বল ছিল বই। তাঁর প্রথম কবিতা পেত্রিস লুমুুম্বা। প্রথম কাব্য তবক দেয়া পান। গণমানুষের মুক্তি তাঁর কবিতার মূল সুর। শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের জয়গান গেয়েছেন তিনি। তাঁর বিভিন্ন কবিতায় সমাজের দেশের জাতির অসুন্দর থেকে মুক্তি এবং সুন্দরের আকুতি ছিল কবিতায় পরতে পরতে। তাঁর ধারণা কৃষিভিত্তিক সমাজে ঠকানোর মানসিকতা থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি হয়। ধর্মীয় ক্ষেত্রে, স্বাধীনতার নামে, সংস্কৃতির নামে শোষণ চলত। তিনি বলতেন যুদ্ধ করার জন্য মানুষ পাগল না তেমন। কিন্তু যুদ্ধাস্ত্র কেনার জন্য পাগল। ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ তাঁর কবিতায় পেয়েছে ভিন্নমাত্রা। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যে বঞ্চিত হচ্ছে তা ভাষার ক্ষেত্রে প্রথম দেখা যায়। মানুষ রাজনীতি সচেতন হয়নি কিন্তু দলবাজি করতে শিখেছে।

সত্যানুসন্ধিৎসু কবি সত্যের সাধানাই করে গেছেন আজীবন। কারণ জীবন থেকে সত্য চলে গেলে জীবন মহিমা হারায়। তাই কপট সমাজের চিত্র দেখে তিনি মর্মাহত ছিলেন। সেই ক্ষেদোক্তি তাঁর কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে। ‘সত্য ফেরারী’ কবিতায় আমরা তাঁর প্রকাশ লক্ষ করি।

কোথায় পালালো সত্য?
দুধের বোতলে, ভাতের হাড়িতে! নেই তো
রেস্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে,
গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে,
টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে,
নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো।

শুধু তাই নয়, স্রোতে গাঁ না ভাসিয়ে খুব বিনয়ের সাথে তিনি নিজের অবস্থান তুলে ধরেছেন। আশ পাশের মানুষের দৃষ্টির উদাসীনতাকে তিনি কটাক্ষ করেছেন। কায়দা করে পাশ কাটিয়ে কোনো কিছু ইনিয়ে বিনিয়ে বলবার মানুষ তিনি নন। তাই ‘বলার জন্য বলা’ কবিতায় তিনি তাঁর সংগ্রামী চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। শোষকের দিকে ছুড়ে মেরেছেন তাঁর দ্রোহের কবিতা।

মানুষ, আমি কোনোদিন তোমাদের কাছে
মেঘের হিসেব চাইনি।
আমিওতো বলতে পারতাম
তোমাদের আঘাতে এবং দারুণ অবহেলায়
এই যে জোৎস্না অকারণ টুপ টুপ করে ঝড়ে গেল
তোমাদের দৃষ্টির এই উদাসীনতা কেন?
বলিনি !
কেননা তোমরা তখন ধান্ধায় মেতে আছো
মানুষ আর পাতার আন্দোলন
আমিতো মেনেই নিয়েছি।
আমিওতো আমার দুর্বল এবং প্রায় ব্যক্তিগত লেখাগুলো
এক সময় উদ্ধত শোষকের দিকে
সজোরে ছুড়ে দিয়েছিলাম যতটুকু সাধ ছিল।
দেইনি?

একজন কবির সত্তায় দেশপ্রেম কতটা জাগ্রত থাকলে তিনি বলতে পারেন।
নদীর জলে আগুন ছিল
আগুন ছিল বৃষ্টিতে
আগুন ছিল বীরাঙ্গনার উদাস করা দৃষ্টিতে।
[ তখন সত্যি মানুষ ছিলাম]

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি ভূমিকা ছিল কবির। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এসেছে বারবারাকে প্রশ্নের ভেতর দিয়ে।
আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে বারবারা
তোমাদের কাগজে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খাঁর ছবি ছাপা হয়-
বিবেকের বোতামগুলো খুলে হৃদয় দিয়ে দেখো
ওটা একটা জল্লাদের ছবি
পনেরো লক্ষ নিরস্ত্র লোককে ঠান্ডা মাথায় সে হত্যা করেছে
মানুষের কষ্টার্জিত সভ্যতাকে সে গলা টিপে হত্যা করেছে
অদ্ভুত জাদুকরকে দেখ
বিংশ শতাব্দীকে সে কৌশলে টেনে হিঁচড়ে মধ্যযুগে নিয়ে যায়।

চিরাচরিত কোনো নীতিকথা শুনিয়ে কবি থেমে যান নি। তিনি প্রবল পরাক্রমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আহবান জানিয়েছেন। যে সংগ্রামী চেতনা কবিকে মুক্তিসংগ্রামে অবতীর্ণ করেছিল। সেই চেতনায় আমাদের সভ্যতা, দর্শন সাহিত্যকে তিনি সুরক্ষা দেবার আহবান জানিয়েছেন-

বারবারা এসো,
রবিশঙ্করের সুরে সুরে মুমূর্ষু মানবতাকে গাই
বিবেকের জংধরা দরোজায় প্রবল করাঘাত করি
অন্যায়ের বিপুল হিমালয় দেখে এসে ক্রুদ্ধ হই, সংগঠিত হই
জল্লাদের শাণিত অস্ত্র
সভ্যতার নির্মল পুষ্পকে আহত করার পূর্বে,
দর্শন ও সাহিত্যকে হত্যা করার পূর্বে
এসো বারবারা বজ্র হয়ে বিদ্ধ করি তাকে।

কবি আসাদ চৌধুরী পেত্রিস লুমুম্বা কবিতায় কঙ্গোর মহান নেতাকে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা নির্মমভাবে হত্যা করে। কবি এ নেতার হত্যাকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। রনেশ দাস গুপ্ত সংবাদের এডিটোরিয়াল পৃষ্ঠায় ‘পেত্রিস লুমুম্বা’ কবিতাটি ছাপান। মানুষ এতো নিষ্ঠুর হতে পারে এ চেতনা থেকেই কবিতার সৃষ্টি।
কবি আসাদ চৌধুরীর কবিতা শুনলে বা পাঠ করলে হৃদয়ের তন্ত্রীগুলো উজ্জীবিত হয়। তিনি দ্রোহ আর সুন্দরকে ধারণ করেছেন তাঁর লেখাগুলোতে। শোষণ শাসনের বেড়াজাল থেকে মুক্তিকামী মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনার স্বপ্ন দেখেছেন। আমরা তাঁর স্বপ্নকে ধারণ করবো এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌছে দেবার অঙ্গীকার করবো। চির সবুজ চির তরুন কবিকে আমরা মনে রাখবো। তিনি চেয়েছেন আমরা যেন লোভে ও উদ্ধত খড়গের ভয়ে আপোষ করে সত্যভ্রষ্ট না হই। তিনি জনপ্রিয় হতে চাননি। তিনি প্রিয় হয়ে আছেন। তিনি চলে যাননি। সবার হৃদয়ে আছেন।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভালুম আতাউর রহমান খান ডিগ্রি কলেজ, ধামরাই, ঢাকা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here