বিজয় দিবস: পরিবর্তনের পথে এক নতুন অধ্যায়

0
204
সৈয়দ তোশারফ আলী 
১৬ই ডিসেম্বর, ঐতিহাসিক বিজয় দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছে জাতি। এক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, মুক্ত পরিবেশে, এই বিজয় দিবস অবশ্যই নতুন অর্থ বহন করে। জাতি বর্তমানে একটি সংকটকালীন সময় অতিক্রম করছে। এই সংকটময় সময়ে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং প্রতিরক্ষা চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হতে জনগণের ঐক্যবদ্ধ হওয়া অত্যন্ত জরুরি। রাজনৈতিক পার্থক্য থাকবেই, তবে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো দেশের হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস বারবার জাতীয় ঐক্যের ওপর জোর দিয়েছেন। এটি স্পষ্ট যে বর্তমান সরকার একা জাতির সামনের চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধান করতে সক্ষম নয়। পূর্বে, মিয়ানমারে চলমান সশস্ত্র সংঘর্ষ কেবল রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাই বাড়াচ্ছে না, বরং বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তা হুমকিও সৃষ্টি করছে। একই সঙ্গে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মনিপুর রাজ্যে অশান্তি এবং পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উসকে দেওয়ার চেষ্টাগুলো এই অঞ্চলের অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। হিন্দুস্তানি মিডিয়া ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে ইতিমধ্যে কুখ্যাতি অর্জন করেছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। ভারত বাংলাদেশে তাদের বাজার পুনরুদ্ধার করতে চাইলেও বাংলাদেশ ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে নতুন বন্ধুত্বের সন্ধান করছে। বন্ধুত্বের নামে বাংলাদেশ আর কখনো পরাধীনতা মেনে নিতে চায় না। এই চেতনা নিয়ে জাতি ঐতিহাসিক বিজয় দিবস উদযাপন করতে প্রস্তুত। আমরা আশা করি, নতুন প্রজন্ম এই দিনে তাদের অনন্য উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবে।
আমাদের লক্ষ্য স্পষ্ট: আমরা এমন একটি গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে চাই যা একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানের অধীনে মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করবে। সম্মানের সঙ্গে জীবন যাপন করতে চাই এবং আইনের সুরক্ষা ভোগ করতে চাই। যেখানে আইন নেই, সেখানে গণতন্ত্র নেই, সহনশীলতা নেই এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও নেই। ঐতিহাসিক বাস্তবতায়, ইসলামী মূল্যবোধ—সমাজে সমতা ও ন্যায়বিচার—জনজীবনে অগ্রাধিকার পেতে হবে। একই সময়ে, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য কঠোরভাবে সংরক্ষণ করতে হবে যাতে বাংলাদেশ বিশ্বে একটি উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে।
এই লক্ষ্যগুলো অর্জন করা সম্ভব যদি আমাদের রাজনৈতিক নেতারা দলীয় স্বার্থের চেয়ে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ অমানবিক দমন-নিপীড়নের শিকার হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত, জনগণ ছাত্রদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শেখ হাসিনার অধ্যায় বন্ধ করে দেয়। শেখ হাসিনা কীভাবে দেড় দশক ধরে ফ্যাসিবাদী শাসন চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন তা গবেষণার বিষয়। ১৯৭১ সালের পর, দ্বিতীয়বারের মতো, স্বাধীনতার জন্য আমাদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। শহীদদের সংখ্যা প্রায় ২,০০০-এ পৌঁছেছে, এবং তাদের অধিকাংশই ছাত্র।
শাসন পরিবর্তন গণতন্ত্রের জন্য আশা নিয়ে এসেছে, তবে কাঠামোগত সংস্কার এখনো পর্যাপ্ত নয়। স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলো ইতোমধ্যেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে, তাদের হারানো সুবিধাগুলো পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে। শেখ হাসিনার শাসনামলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তা পুনরায় চিন্তা করলে জনসেবার প্রতি নতুন করে সতর্কতা ও রক্ষাকবচ প্রয়োজন।
জাতি একটি গণতান্ত্রিক সরকারের অপেক্ষায় রয়েছে—যে সরকার জনগণের প্রতি স্বচ্ছ ও জবাবদিহি করবে। তবে এটি সহজ কাজ নয়। রাজনৈতিক ধারা পরিবর্তিত হয়েছে, এবং সাংবিধানিক আদর্শ ও বাস্তব পরিচালনার মধ্যে ফারাক দিন দিন বেড়ে চলেছে। নির্বাচনে অর্থ ও শক্তির প্রভাব গণতান্ত্রিক নীতিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। আইনস্টাইনের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলোর সেবা করে, যার ফলে অসৎ প্রার্থীরা আইনসভায় আধিপত্য বিস্তার করে। রাজনৈতিক দল ও মনোনয়ন প্রক্রিয়ার সংস্কার একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য অপরিহার্য।
ড. ইউনুস, যদিও তিনি পেশাদার রাজনীতিবিদ নন, এখন রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং মতাদর্শগত বিভাজন দূর করার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। তাকে বুঝতে হবে যে আগস্ট পরিবর্তনের বিরোধীরা এখনো সক্রিয়, যারা মিডিয়া, ক্যাডার, বিদেশি সহযোগিতা এবং আর্থিক সম্পদের মাধ্যমে ষড়যন্ত্র করছে। শীর্ষ নেতারা তাদের অপরাধের জন্য বিচারের মুখোমুখি হতে পারে, তবে মধ্য-স্তরের নেতাদেরকেও অন্তত দুর্নীতি, অর্থপাচার এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণার নিন্দা জানাতে হবে।
সরকারের এই সংক্রমণকালীন সময়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ চেইন কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। উৎপাদন, মজুদ এবং আমদানির সঠিক তথ্য দক্ষ পেশাজীবীদের দ্বারা পুনঃ পুনঃ পর্যবেক্ষণ করা এবং প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিদিন রিপোর্ট করা উচিত যাতে তথ্য-ভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়।
বিজয় দিবস শুধু আমাদের গৌরবময় অতীতের উদযাপন নয়—এটি সহনশীলতা, ঐক্য এবং ন্যায়বিচারের চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ আহ্বান। এটি আমাদের জন্য একটি আশার বাতিঘর, যা স্মরণ করিয়ে দেয় যে শহীদদের ত্যাগের মূল্যায়ন করতে হলে আমাদের দায়িত্ব একটি উজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা।
আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করে তাদের ত্যাগের মর্যাদা অটুট রেখে এমন একটি দেশ গড়ে তুলব, যা শান্তি, উন্নয়ন এবং সমতার মূর্ত প্রতীক হবে। এই বিজয় দিবস হোক আমাদের ঐক্য, ন্যায়বিচার এবং গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকার নবায়নের প্রেরণা, যাতে বাংলাদেশ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার এক উজ্জ্বল প্রতীক হিসেবে চিরকাল অমলিন থাকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here