হারুকি মুরাকামির সাম্প্রতিক গল্প: ‘কাহো’

বিশ্বখ্যাত জাপানি কথাসাহিত্যিক হারুকি মুরাকামির সদ্য প্রকাশিত এই গল্প ছাপা হয়েছে ‘নিউ ইয়র্কার’ পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণের ৮ ও ১৫ জুলাই, ২০২৪ তারিখের সংখ্যায়। গল্পটিতে এই লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন কাহো নামের এক মেয়ের বেদনা। মূল জাপানি ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ফিলিপ গ্যাব্রিয়েল। আর ইংরেজি থেকে বাংলা ভাষান্তর করেছেন ফারুক মঈনউদ্দীন ।

0
32

ডেজার্ট খাওয়ার পর তখন কফির জন্য অপেক্ষা করছিল ওরা।

লোকটার কথার রেশ শেষ হতে একমুহূর্ত লাগে, তিন কি চার সেকেন্ড হতে পারে। কথাটা আসে আচমকা, ওর মতলবটা তক্ষুনি বুঝতে পারে না কাহো। লোকটা যখন এই ঠোঁটকাটা কথাগুলো বলছিল, পুরোটা সময় হাসছিল ও। একটা ভদ্র বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি। কোনো কৌতুকও ছিল না ওর কথায়। ঠাট্টাও করছিল না, পুরোপুরি সিরিয়াস।

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

একমাত্র প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারত কাহো, কোলের ওপরের ন্যাপকিনটা টেবিলের ওর ছুড়ে ফেলে পাশের চেয়ারে রাখা পার্সটা তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারত, তারপর একটি কথাও না বলে বেরিয়ে যেতে পারত রেস্তোরাঁ থেকে। খুব সম্ভবত পরিস্থিতিটা মোকাবিলা করার এটাই হতো সবচেয়ে ভালো উপায়।

কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক, কাহো পারে না সেটা। পরে তার মনে আসে, এটার একটা কারণ, সত্যিই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল ও; দ্বিতীয় কারণ ছিল কৌতূহল। রেগে গিয়েছিল সে, সত্যিই ভয়ানক রাগ হয়েছিল ওর। রাগ হবে না কেন? তবে তার চেয়ে বেশি যেটা ছিল, ওর জানার ইচ্ছা, কী বলতে চাইছিল লোকটা। সে কি সত্যিই কুৎসিত? লোকটার এই মন্তব্যের পেছনে আরও কিছু ছিল কি?

একটু থেমে লোকটা বলেছিল, ‘আপনি খুবই বিশ্রি, কথাটা একটু বাড়িয়ে বলেছি আমি। তবে আমার দেখা মহিলাদের মধ্যে আপনি একেবারে সাদামাটা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’

ঠোঁট দুটি কুঁচকে স্থির দুচোখে নীরবে লোকটার চেহারা নিরীক্ষণ করে ও।

এ রকম একটা কথা বলার কী দরকার ছিল ওর? প্রথমবার দেখা করতে এসে (এ রকমই কিছু ছিল ওটা) যদি অন্যজনকে পছন্দ না হয়, তাহলে পরে আর কোনো যোগাযোগ না রাখলেই হয়। এটাই তো যথেষ্ট। মুখের ওপর অপমান করা কেন?

‘আপনার কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হতে পারে,’ ওদের সামনে দুটি এসপ্রেসো কফি রেখে যাওয়ার পর শান্ত কণ্ঠে বলেছিল লোকটা। যেন পড়তে পেরেছিল কাহোর মনের কথা। একটা ছোট চিনির দলা নিজের কফির মধ্যে ফেলে চুপচাপ নাড়তে থাকে লোকটা। ‘যাকে কুৎসিত মনে হয় অথবা বলা উচিত, যার চেহারা পছন্দ করিনি, তার সঙ্গে শেষ অবধি ডিনার করলাম কেন? প্রথম গ্লাস ওয়াইন শেষ করার পর সাক্ষাৎটা সংক্ষিপ্ত করে ফেলা উচিত ছিল আমার। দেড় ঘণ্টা সময় নিয়ে তিন পদের ডিনার খেয়ে পুরো সময়টা নষ্ট, তাই না? একেবারে শেষে এসে এ রকম একটা কথা কেন বলতে হলো আমাকে?’

টেবিলের ওপাশের লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকে কাহো। কোলের ওপর ন্যাপকিনটা দুহাতে চেপে ধরা।

লোকটা বলে, ‘মনে হয় নিজের কৌতূহলটা চেপে রাখতে পারিনি আমি। বোধ হয় জানতে চেয়েছিলাম, আপনার মতো একজন সত্যিকার সাদাসিধে মহিলা কী ভাবছে, এ রকম সাদামাটা হওয়াটা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে আপনার জীবনটাকে।’

কাহো ভাবে, ‘আপনার কৌতূহল মিটেছিল কি?’ তবে সেটা জিজ্ঞেস করে না মুখ ফুটে।

কফিতে চুমুক দিয়ে লোকটা বলে, ‘আমার কৌতূহল কি মিটেছিল?’ কোনো ভুল নেই, ওর মনের কথা বুঝতে পারছিল লোকটা। ঠিক যেভাবে পিঁপড়েভোজী প্রাণী উইঢিবিকে লম্বা সরু জিব দিয়ে চাটে।

মাথাটা সামান্য নেড়ে কাপটা পিরিচের ওপর নামিয়ে রাখে লোকটা। তারপর নিজের প্রশ্নের জবাব দেয়, ‘না, মেটেনি।’

হাত তুলে ওয়েটারকে ডাকে লোকটা, তারপর বিল মিটিয়ে দেয়। কাহোর দিকে ফিরে সামান্য বাউ করে সোজা বেরিয়ে যায় একবারও ফিরে না তাকিয়ে।

সত্যি বলতে, বাচ্চা বয়স থেকেই নিজের চেহারা নিয়ে তেমন আগ্রহ ছিল না কাহোর। আয়নায় নিজের যে চেহারা দেখত, সেটা সুন্দর কিংবা বিশেষ রকম বিশ্রি বলে মনে হয়নি কখনো। হতাশ বা খুশি কোনোটাই হতো না সে। চেহারা ওর জীবনের কোনো ক্ষতি করছে না, এমন ভাবনা থেকেই চেহারা সম্পর্কে অনাগ্রহ জন্মায় ওর। কিংবা বোধ হয় এভাবে বলা ভালো, এ বিষয়ে জানার কোনো সুযোগ ঘটেনি ওর। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ও, তাই সুশ্রী হতে পারত কি পারত না, তার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল না ওদের স্নেহ।

কৈশোর পার হওয়ার পরের সময়টুকুতেও নিজের চেহারার বিষয়ে উদাসীন ছিল ও। বান্ধবীদের বেশির ভাগেরই ছিল নিজেদের চেহারা নিয়ে উদ্বেগ। বইতে পাওয়া যায়, এমন সব ধরনের মেকআপ নিত ওরা, নিজের ব্যাপারে কখনো এ রকম তাগিদ অনুভব করেনি ও। ওর একমাত্র নজর ছিল নিজের শরীর ও চেহারাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়ে। আর সেটা কখনোই তেমন কোনো কঠিন কাজ ছিল না।

একটা কো-এডুকেশন সরকারি কলেজে পড়ত ও, ছেলেবন্ধুও ছিল কয়েকজন। ওর ক্লাসের ছেলেদের যদি ওদের প্রিয় সহপাঠিনীকে ভোট দিতে বলা হতো, কখনোই জিততে পারত না কাহো, সে রকম ছিল না ও। তারপরও কোনো কারণে, সব ক্লাসেই দু-একজন ছাত্র আগ্রহী ছিল ওর ব্যাপারে, ওরা প্রকাশও করেছে সেটা। ওর ঠিক কোন বিষয়টাতে আগ্রহী ছিল ওরা, জানে না কাহো।

এমনকি কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে টোকিওর আর্ট স্কুলে যখন ভর্তি হয়, তখনো কদাচিৎ ছেলেবন্ধুর অভাব হয়েছে ওর। তাই ও আকর্ষণীয় কি না, এ ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। সেই অর্থে ভাগ্যবতী বলা যায় ওকে। ওর কাছে অদ্ভুত লাগত, যেসব বান্ধবী ওর চেয়ে দেখতে অনেক ভালো, তারাও নিজেদের চেহারা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগত, বহু পয়সা খরচ করে প্লাস্টিক সার্জারিও করিয়েছে কেউ কেউ। কখনোই বিষয়টার তল পায়নি কাহো।

তাই ছাব্বিশ বছর পার হওয়ার পর প্রথম দেখাতেই লোকটি যখন বেমক্কা বলে দিল যে সে কুশ্রী, সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যায় কাহোর। লোকটার কথায় আঘাত না পেয়ে পুরোপুরি হতভম্ব ও বিচলিত হয়ে পড়ে সে।

লোকটার সঙ্গে কাহোর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল মাচিদা। কাহোর চেয়ে চার বছরের বড় মাচিদার ছেলেমেয়ে দুজন। ছোটদের বই বের করে এমন একটা ছোট প্রকাশনা সংস্থায় কাজ করত সে। সেই সুবাদে কাহোর লেখা ছোটদের বই সম্পাদনা করত ও। ছবির বইগুলো তেমন ভালো চলত না, তবে এসব কাজের ফাঁকে বিভিন্ন ম্যগাজিনের অলংকরণ করে চলার মতো যথেষ্ট আয় করত কাহো। এই সাক্ষাতের মাত্র কিছুদিন আগে প্রায় দুই বছর ধরে চলা সমবয়সী এক লোকের সঙ্গে সম্পর্কটা ছাড়ান-কাটান হয়ে গিয়েছিল ওর, অস্বাভাবিক বিষণ্ন হয়ে পড়েছিল সে। ভাঙনটা একটা তেতো স্বাদ রেখে গিয়েছিল ওর ভেতর। কিছুটা এই কারণেই কাজকর্মে ভাটা পড়েছিল ওর। ব্যাপারটা জানত বলে প্রথম সাক্ষাতের আয়োজনটা করেছিল মাচিদা। বলেছিল, ‘তোমার চলার ছন্দটা ঠিক হয়ে যেতে পারে।’

লোকটার সঙ্গে দেখা হওয়ার তিন দিন পর মাচিদা ফোন করে ওকে।

প্রথমেই জিজ্ঞেস করে, ‘বলো, কেমন ছিল তোমাদের সাক্ষাৎ?’

সরাসরি জবাব এড়িয়ে কাহো কেবল অস্পষ্ট জবাব দেয়, ‘হুঁ।’ তারপর পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘ মানুষটা কী ধরনের?’

মাচিদা বলে, ‘সত্যি বলতে, ওর সম্পর্কে বেশি কিছু জানি না আমি। বন্ধুর বন্ধু বলতে পারো। মনে হয় বয়স চল্লিশের মতো, এখনো বিয়ে করেনি, কোনো এক ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানিতে কাজ করে। ভালো ঘরের ছেলে, কাজকর্মে ভালো। যত দূর জানি, কোনো খারাপ রেকর্ড নেই। একবারই দেখা হয়েছিল ওর সঙ্গে, কয়েক মিনিট কথা হয়েছিল, মনে হয়েছে লোকটা দেখতে ভালো এবং যথেষ্ট হাসিখুশি। স্বীকার করছি একটু খাটো সে, তবে টম ক্রুজও তো তেমন লম্বা নয়। এমন নয় যে টম ক্রুজকে নিজ চোখে দেখেছি আমি।’

কাহো জিজ্ঞেস করে, ‘কিন্তু একটা হ্যান্ডসাম, আকর্ষণীয়, ভালো চাকুরে আগে থেকে জানাশোনা নেই, এমন কারও সঙ্গে ডেটিং করার ঝামেলায় যাবে কেন? ওর সঙ্গে যাওয়ার জন্য তো বহু মেয়ে ছিল।’

মাচিদা বলে, ‘আমারও তা-ই মনে হয়। এমনিতে খুব শার্প ও, নিজের কাজে ভালো, তবে শুনেছি ওর স্বভাবটা একটু আজব। দেখা হওয়ার আগেই ওর সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা দিতে চাইনি বলে কথাটা জানাইনি তোমাকে।’

কথাটার পুনরাবৃত্তি করে কাহো বলে, ‘একটু আজব?’ মাথা ঝাঁকায় ও। এটাকে একটু আজব বলা যায়?

মাচিদা জিজ্ঞেস করে, ‘তোমরা কেউ কারও ফোন নম্বর রাখোনি?’

জবাব দেওয়ার আগে একটু থামে কাহো। ফোন নম্বর বিনিময়? তারপর বলে, ‘না রাখিনি কেউ।’

তিন দিন পর মাচিদা আবার ফোন করে ওকে।

বলে, ‘হ্যান্ডসাম সাহারার ব্যাপারে ফোন করলাম তোমাকে। কথা বলা যাবে?’ সাহারা হচ্ছে ওর সঙ্গে প্রথম ডেটিং করা লোকটার নাম। নামের উচ্চারণটা সাহারা মরুভূমির মতো। হাতের ড্রয়িং পেনসিলটা নামিয়ে রেখে ফোনটা বাঁ হাত থেকে ডান হাতে নেয় কাহো। বলে, ‘নিশ্চয়ই, বলো।’

মাচিদা বলে, ‘কাল রাতে ফোন করেছিলে লোকটা। বলছে, তোমার সঙ্গে আরেকবার দেখা করতে চায়, তোমরা দুজন আরেকবার কথা বলতে পারো কি না। বেশ সিরিয়াস মনে হলো ওকে।’

একটা লম্বা শ্বাস ঠেকাতে পারে না কাহো, একমুহূর্ত চুপ করে থাকে। লোকটা আরেকবার দেখা করতে চায়, যাতে দুজন কথা বলতে পারে। কথাটা বিশ্বাস করতে পারে না যেন।

মাচিদার উদ্বিগ্ন গলা শোনা যায়, ‘কাহো সান, শুনছ তুমি?’

কাহো বলে, ‘হ্যাঁ, শুনছি।’

‘তোমাকে ও পছন্দ করেছে বলে মনে হয়। ওকে কী বলব?’

সাধারণ বুদ্ধিতে ‘না’ করে দেওয়াই উচিত। মুখের ওপর এমন জঘন্য কথা বলতে পারে যে লোক, তার সঙ্গে আবার দেখা করার কী দরকার? তবু সেই মুহূর্তে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারে না ও। ওর মাথার মধ্যে কিছু সন্দেহ একসঙ্গে ঢুকে পড়ে জট পাকিয়ে যায়।

মাচিদাকে বলে, ‘একটু ভেবে নিই? তোমাকে ফোন করব আমি।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here