নূরজাহান বেগম
একটি জাতির মেরুদণ্ড সোজা করতে মাধ্যমিক শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার। সুতরাং আমাদের দেশের মত উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানের করত দক্ষ মানবসম্পদ গড়াই হলো শিক্ষার মূল লক্ষ্য। এর মাধ্যমে এসডিজি ও ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য বিশ্বে অভিযোজনক্ষম দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে এই সেক্টরকে নিয়ে নতুনভাবে ও ভিন্নভাবে ভাবা একান্ত জরুরি।
আর মাধ্যমিক শিক্ষার উপর যেহেতু একজন নাগরিকের অবস্থা ও অবস্থান নিশ্চিত হয় এবং শিক্ষাজীবনের সবচেয়ে বেশি সময় জুড়ে এই অংশে একজন শিক্ষার্থী অতিবাহিত করে তাই মাধ্যমিক শিক্ষাকে সময়, অর্থ ও শ্রম ইনভেস্টমেন্টের মাধ্যমে একে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
এজন্য সরকারি বা বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকগণ স্টেক হোল্ডার হওয়ায় তথা মাধ্যমিক শিক্ষার সার্বিক দিক জানা আছে বিধায় মাধ্যমিক শিক্ষার কর্মকর্তার পদগুলিতে শিক্ষকদের যাওয়া আবশ্যক এবং এই পদগুলো সততার সাথে শিক্ষকগণ পরিচালনা করবেন। যা এখনো হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না তা বোঝার আর বাকি নেই।
বিগত প্রায় ৩০ বছর যাবত মাধ্যমিক শিক্ষার দিকে একটু লক্ষ করলে দেখা যায় — উপবৃত্তি বন্টনকারী থেকে রাজস্ব ভাগিয়ে নিয়ে এবং পিয়ন থেকে শিক্ষা অফিসার হওয়ার যে হিড়িক পড়েছে তাতে ১০০% স্পষ্ট যে এতে করে মাধ্যমিক শিক্ষাকে একটা গর্তে ফেলে দিয়েছে অথচ সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার থেকে শুরু করে মাধ্যমিকের সকল সেক্টরে মাধ্যমিক শিক্ষকদের জন্য এক্সেস রাখা হয়েছে কিন্তু কেন আজও শিক্ষকগণের উপজেলার এই পদগুলোতে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না তা একটু সরেজমিনে নজর দিলেই স্পষ্ট হয় এবং তা বের করতে কোনো রকেট সাইন্স লাগে না।
যেখানে নিয়োগ বিধি নেই থাকলেও স্পষ্ট বলা আছে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে তাদের বিনা নোটিশে চাকরির মেয়াদ শেষ হবে সেখানে এটিইওগণ ঠিকই বিভিন্ন জায়গায় অরাজকতা সৃষ্টি করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ “শিক্ষা এবং এর স্বকীয়তা”কে পিছু হটতে বাধ্য করেছে তাদের বিভিন্ন কার্যকলাপের মাধ্যমে; যার কারণে আজ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে সরকারি বেসরকারি শিক্ষকসহ গোটা মাধ্যমিক সেক্টরটাই যেন এক অশনি চাদরে ঢেকে গিয়েছে। তেমন কোনোই পরিবর্তন হয় নি। শিক্ষকদের সকল কাজে বাঁধা; ফাইল পড়ে থাকে বছরের পর বছর; কোনো কাজ হয় না এমনকি পাওনাটাই পড়ে আছে দুই যুগেরও অধিক সময় ধরে। কেন ন্যায্য দাবিগুলিও পূরণ হচ্ছে না!!
শিক্ষকগণ মাইর খাইলেও দেখা যায় কর্তাদের গায়ে লাগে না অথচ অশিক্ষকদের জন্য তাদের অন্তর পুড়ে যাচ্ছে। বারবার পূনর্বাসন করেও ক্ষান্ত থাকেনি। শিক্ষকগণ লাঞ্ছিত ও অবহেলিত কিন্তু সেগুলো বিচার বহির্ভূত এবং তাদের কোনো উন্নতি হয়নি অথচ পিয়ন থেকে তারা সাচিবিক পদ পর্যন্ত তারা পেয়ে যাচ্ছে। সেলুকাস!!
এটা যদি বলি যে শুধু তারা চায় দেখে পায় ব্যাপারটা এমন নয় এদেরকে দিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে উপজেলার ক্ষুদ্র অফিস পর্যন্ত অর্থ লগ্নির অস্বচ্ছ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে একটা ব্যাবসায়িক চাকরি হিসেবে রূপান্তরিত করেছে।
যেখানে মাধ্যমিক শিক্ষকসমাজ একে সংস্কার করে একটা স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক শিক্ষা ডিপার্টমেন্ট গড়তে চায় কিন্তু এটাই অনেকের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অতএব ইনটেরিম গভ:সহ যাঁরা শিক্ষা সংস্কারে বিশ্বাস করেন এবং করতে চান বা সায় দিতে চান তাঁরা দয়া করে খেয়াল করুন এই মাধ্যমিক শিক্ষার সকল পর্যায়ে কোনো অশিক্ষক নয় বরং শিক্ষকদেরকে ১০০% এক্সেস যেন দেওয়া হয় তাহলে এটাই হবে একটা সংস্কার এবং শিক্ষায় বিপ্লব।
শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডাটা কালেকশন, কারিকুলাম প্রণয়ন, বাস্তবায়নসহ সকল তথ্য পেতে শিক্ষকগণ হলো প্রাইমারি সোর্স। তাই বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের মত মাধ্যমিক শিক্ষার সকল ডিপার্টমেন্ট মাধ্যমিক শিক্ষকদের দ্বারা পরিচালিত হবে এটাই স্বাভাবিক।
অতএব সংস্কারে যাঁরা আছেন তাঁরা ভেবে দেখবার অনুরোধ করছি। মাধ্যমিক সেক্টরকে আপডেট করলে যা যা লাগবে–
★ মাধ্যমিক শিক্ষকদের বেতন গ্রেড উন্নয়ন করে তথা ৯ম গ্রেড ধরে অধিদপ্তর আলাদা করা ও বেসরকারি মাধ্যমিককে জাতীয়করণ করে মাধ্যমিককে একটি যুগোপযোগী জায়গায় নিয়ে যাওয়া।
★ কোনো অশিক্ষক শিক্ষার কর্মকর্তা হতে পারবে না বরং শিক্ষকই হবেন শিক্ষার কর্মকর্তা- স্পষ্ট কথা।
এতে পদসোপানের ধারা, জনবলের কাঠামো ও অবস্থা হবে —-
★ সহকারী শিক্ষক/সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার(৯ম)– এন্ট্রি পদ(সরাসরি নিয়োগ)– সকল স্কুলে সকল বিষয়ের(১৩টি) শিফট প্রতি ৩০ জন করে ও উপজেলায় ১জন করে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন।
★ সিনিয়র শিক্ষক/ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার(৬ষ্ঠ গ্রেড), ৭ বছর পর পদোন্নতির ভিত্তিতে হবেন। এর মধ্যে প্রতি প্রতিষ্ঠানে শিফট প্রতি সাবজেক্ট প্রতি যোগ্যতা অনুযায়ী ১জন করে হেড অব সাবজেক্ট থাকবেন।
★ সহকারী প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষা গবেষণা কর্মকর্তা(৫ম গ্রেড)- পদোন্নতি(৮০%)- পূর্ব পদে ৩ বছর চাকুরির অভিজ্ঞতায় জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ও বিভাগীয় পরীক্ষার(২০%) মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন।
★ প্রধান শিক্ষক/জেলা শিক্ষা অফিসার ও জেলা শিক্ষা গবেষণা কর্মকর্তা, প্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষা গবেষণা কর্মকর্তা(৪র্থ গ্রেড)- পূর্ব পদে ৩ বছর চাকুরির অভিজ্ঞতায় জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে।
চারস্তরীয় এই পদসোপান করলে মাধ্যমিকের ৯৯৯ (সহকারী প্রধান শিক্ষক, সিনিয়র শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক তিনটি নবম গ্রেড) সংকট একদিকে যেমন কাটবে তেমনি মাধ্যমিকে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপের মাধ্যমে শিক্ষা সংস্কারে ভূমিকা রাখবে।
➡️ পরবর্তীতে পদোন্নতির মাধ্যমে মেধা, অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী —-
★ ডিডি(১ জন- জেলা শিক্ষা অফিসার/প্রধান শিক্ষক থেকে) ও আঞ্চলিক শিক্ষা গবেষণা কর্মকর্তা (১ জন- জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা গবেষণা কর্মকর্তা থেকে)(৩য় গ্রেড)
★ মাধ্যমিক অধিদপ্তরে এডি(প্রশাসন, প্ল্যানিং & ডেভেলপমেন্ট, প্রশিক্ষণ, অর্থ— ডিডি থেকে) ও সহকারী শিক্ষা গবেষণা পরিচালক(আঞ্চলিক শিক্ষা গবেষণা কর্মকর্তা থেকে) (৩য় গ্রেড)
★ মাধ্যমিক অধিদপ্তরের পরিচালক-১(সরকারি) ও পরিচালক- ২(বেসরকারি) ও মাধ্যমিক শিক্ষা গবেষণা পরিচালক (২য় গ্রেড) হবেন জ্যেষ্ঠতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে।
★ মহাপরিচালক (মাধ্যমিক অধিদপ্তর) সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা বিসিএস সাধারণ শিক্ষা কর্মকর্তা(পদায়ন)
এন্ট্রি পদ সহকারী শিক্ষক/সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার পদ ৭ বছর পর এবং এটা ছাড়া বাকি পদগুলো প্রতি ৩ বছর পরপর আপডেট হবে অর্থাৎ পরবর্তী পদে পদোন্নতি বা পদায়নের যোগ্য হবে।
পদোন্নতির প্রতিটি ধাপের ক্ষেত্রেই অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও যোগ্যতা যাচাই পূর্বক হবে।
★★ শিক্ষার সকল ডিপার্টমেন্টে যুগোপযোগী, স্বচ্ছ, জবাবদিহিতামূলক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ সিস্টেম চালু পূর্বক সকল শিক্ষকের জন্য আলাদা শিক্ষা কমিশন গঠন ও সেই অনুযায়ী পে-স্কেল প্রদান করত শিক্ষাকে সংস্কার করার মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়ন যেমন সম্ভব তেমনি বেকারত্ব দূরীকরণসহ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সমৃদ্ধ জাতি গঠনে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
লেখক : সহকারী শিক্ষক, ব্রাহ্মন্দী কামিনী কিশোর মৌলিক সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, নরসিংদী।