আবদুর রহমান মল্লিক
মহান মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা আমাদের গর্ব ও অহঙ্কারের জায়গা। তিনটি বিষয় আমাদের জাতীয় চেতনার সঙ্গে মিশে আছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানা কথা থাকলেও জাতির জন্য এটি ছিল অপরিহার্য। তাই মুক্তি পাগল মানুষ মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সীমাহীন ত্যাগ তিতিক্ষা ও রক্তদানের মধ্যদিয়ে সাতকোটি মানুষের সংগ্রামী চেতনা জয়যুক্ত হয়েছিল। যেসব মুক্তিযোদ্ধা জনগণের পক্ষে প্রবল পরাক্রমে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন তারা দেশের সূর্যসন্তান-তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা কারা ধরে রেখেছেন কারা স্বার্থপরতায় ডুবে গিয়েছেন সেটি ভিন্ন আলোচনা। পরাধীন ছিলাম একটা স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি সেটাই শেষ কথা। আর সেই গর্ব বুকে নিয়ে প্রাণ খুলে গাই-একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার, বিশে^র বিস্ময় তুমি আমার আমার অহঙ্কার…।
স্বাধীন রাষ্ট্রের পরিচিতিমূলক দুটো জিনিসের একটি তার জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত। মুক্তিযুদ্ধে যারা অবদান রেখেছেন, সেই চেতনাকে বুকে ধারণ করেছেন তারাই জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত নির্বাচনে ভূমিকা রেখেছেন। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে তারা এ বিষয়ে মতামত দেবার কথা ছিল অবান্তর। যারা দেশের জন্য প্রাণদান করে, রক্ত দেয় সীমাহীন কষ্ট সহ্য করে বিজয়ের পর তারাই নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সূচনা লগ্নে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারীরাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। যে পতাকাকে বায়ান্ন বছর ধরে সম্মান জানিয়ে আসছি, যে জাতীয় সংগীত হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে গেয়ে আসছি সেটা নিয়ে কথা উঠছে। এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে। কেউ কেউ ধর্মীয় যুক্তি নিয়ে আসছেন। যে যুক্তি দিয়ে এক সময় কবি নজরুল ও কবি আল্লামা ইকবালকেও কাফের বলা হয়েছে। যখন কোনো গান কোনো কবিতা কালোত্তীর্ণ হয়ে ওঠে তখন সেটা কার রচনা সেটা বিবেচ্য হয় না। ভারতের রণসঙ্গীত আল্লামা ইকবালের লেখা হলেও তারা সে সঙ্গীত প্রাণ খুলে গায়।
আমাদের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের চিন্তা এসেছে সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক চিন্তা ও ধমীয় কূপমন্ডুকতা থেকে। সন্তানের জন্য বাবার চাইতেও বেশি আবেগের জায়গা মা। দেশটাকে আমরা মায়ের সাথে তুলে করি। মায়ের কোলো যেমন সন্তান নিরাপদ তেমনি একটি নিরাপদ দেশ আমরা কামনা করি। দেশটাকে মাতৃভূমি কিংবা মায়ের সাথে তুলনা এক চমৎকার অনুভূতি। ‘মা তোর বদন খানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি’। মা যদি ভালো না থাকে, তার বদন যদি মলিন হয় তখন নয়ন জলে সন্তানের বুক ভাসে। রক্তদিয়ে কেনা দেশটাতে আর শকুনির থাবা বিস্তার করতে দিতে চাই না। জাতীর পতাকা কেউ খামচে ধরবে সেটাও আমরা চাই না। ছাত্র জনতার যে জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হয়ে গেল তার নেতৃত্ব দিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ লড়াইটা অধিকারের । এ লড়াইটা নির্যাতিত মানুষের মুক্তির। কোনো দলের বিজয় এটি নয়। এ বিজয় জনতার। কারণ একটি শিশু দল বোঝে না। সেও রাজপথে ছিল। একজন মাও তার কোলে শিশু নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিল। পতিত ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার ও তাদের দলীয় লোকজন ছাড়া সবাই এ বিপ্লবের অংশীদার।
আমরা খুব বেদনার সঙ্গে লক্ষ করলাম যখন আহতরা হাসপাতালে কাতরাচ্ছে, মাথার খুলি গুলিতে ঝাঁঝড়া হয়ে গেছে, অনেকের চোখের ভেতর, মাথার ভেতরের বুলেট বের করতে পারছে না সেই সময়ে অনেক অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক বিষয় সুযোগ সন্ধানীরা সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছে। তারা একবার বিবেচনা করে না এই জাতীয় সংগীত কিংবা জাতীয় পতাকা কি এই অন্তবর্তী সরকার পরিবর্তন করার করার ক্ষমতা রাখে? একটি গোষ্ঠী এটা জেনে বুঝে করছে কারণ তারা ক্ষমতায় গেলেও এটি পরিবর্তন করতে পারবে না। তাই ঘোলা পানিতে যদি মাছ শিকার করা যায়। তারা এই ধরনের বিতর্কিত কাজকেও রাষ্ট্রের সংস্কার বলে চালিয়ে দিতে চাচ্ছে।
এই বিতর্ককে উসকে দিয়েছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমান আযমী। বিগত সরকারের পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার এই সেনা কর্মকর্তা আট বছর আয়নাঘর নামক নির্যাতন কেন্দ্রে মানবেতর জীবন যাপন করেন। দেশের সব মানুষ যখন তার প্রতি আন্তরিক সহমর্মীতা প্রকাশ করছিল তখন সংবাদ সম্মেলন ডেকে গুম থাকাকালীন তার প্রতি অমানবিক আচরণের বর্ণনা দেন। সংবাদ সম্মেলনে অপ্রত্যাশিতভাবে আযমী বলেন, ‘বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত যেন নতুন করে লেখা হয়। বর্তমানে যে জাতীয় সংগীত চলছে তা করেছিল ভারত। দুই বাংলাকে একত্রিত করার জন্য করা হয়েছিল এই জাতীয় সংগীত। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে তাই বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত নতুনভাবে হওয়া উচিত। তিনি বলেন, জাতীয় সংগীত করার জন্য অনেক গান রয়েছে। এই সরকারের উচিত নতুন কমিশন গঠন করে একটি নতুন জাতীয় সংগীত তৈরি করা।’ গত ৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে আযমী সংবাদ সম্মেলনে এমনও বলেন, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হননি, নিহতের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ।
তার এই বক্তব্যের পর পক্ষে বিপক্ষে আলোচনার ঝড় ওঠে স্যোশাল মিডিয়ায়। সং¯ৃ‹তি কর্মীরা রাস্তায় নামে এই বক্তব্যের প্রতিবাদে। সারাদেশ প্রতিবাদ শুরু হলে তারই একপর্যায়ে আমরা দেখলাম একটি সংবাদ শিরোনাম। জাতীয় সংগীত: আযমীর বক্তব্য দলের নয়, বলল জামায়াত। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বিবৃতিতে বলেন, “সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী জামায়াতে ইসলামীর সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি নন। জামায়াতে ইসলামীর সাথে তার কোনো সাংগঠনিক সম্পর্ক নেই। ‘তিনি জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিত্ব করেন না। তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন, তা তার একান্ত ব্যক্তিগত। সুতরাং তার বক্তব্যকে জামায়াতে ইসলামীর সাথে সংশ্লিষ্ট করার কোনো সুযোগ নেই।’
জামায়াতের এই রাজনৈতিক বিবৃতির পর আলোচনা অনেকটাই থেমে যায়। জামায়াতকে এই বক্তব্য দিতে হলো কারণ ব্রি. জেনারেল আযমী সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলামের ছেলে। জামায়াত এই মুহূর্তে একটি অযাচিত বিষয়ে জড়াতে চায় না বলে বিবৃতি দিয়ে অবস্থান পরিস্কার করে। রাজনীতিতে জামায়াতের দায়িত্বশীলতা বেড়েছে। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াতের কর্মকান্ডে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। এ সময়ে জাতীয় চেতনার ব্যাপারে তাদের সর্তক থাকা সময়ের দাবি।
শেষ কথা হলো দেশটা আমাদের সবার । সবাই মিলে দেশটাকে সাজাতে হবে। দেশটাকে সাজাতে হবে সুন্দর করে মা যেমন তার ছেলেকে সাজায়। আমাদের তরুন প্রজন্মের ভেতরে সেই চেতনা সঞ্চারিত হয়েছে। তারা দেয়ালে দেয়ালে লিখছে তাদের মনের কথা আর দ্রোহের উচ্চারণ। তাদের গ্রাফিতি আমাদের হতবাক করে দিয়েছে। তারা এখনও দেয়ালের লিখন লিখে যাচ্ছে। আমরা যেন ওদের ভাষা বুঝি। আমরা ওদের নিয়ে গল্প করি। আমরা ওদের আরো সুযোগ করে দেই দেশের জন্য কাজ করার। অহেতুক বিতর্কে না জড়িয়ে সেই উপলব্ধি আমাদের মাঝে জাগ্রত হোক ‘সবার আগে বাংলাদেশ’।