হামিম হাফিজুল্লাহ শেফা
শহরের ব্যস্ততম এলাকায় অবস্থিত বিশাল এক অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স, যেখানে মোট ৬৪টি ফ্ল্যাট এবং প্রায় ৩৫০ জন মানুষ বসবাস করে। এই বিল্ডিংটির চারপাশের পরিবেশ বেশ সুন্দর এবং সুশৃঙ্খল হলেও ভেতরের পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। ফ্ল্যাটগুলিতে বসবাসকারী মানুষদের পেশা, বয়স এবং জীবনযাত্রার ধরন ভিন্ন ভিন্ন হলেও, একে অপরের সঙ্গে এক ধরনের বন্ধন গড়ে উঠেছে। শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, এবং অবসরপ্রাপ্ত মানুষ সবাই মিলে একত্রে একটি কমিউনিটি গঠন করেছে। তবে এই কমিউনিটি পরিচালনার জন্য একটি ম্যানেজমেন্ট কমিটি প্রয়োজন ছিল, যা আগে থেকেই গঠিত হয়েছিল।
কমিটির প্রধান দায়িত্ব থাকে বিল্ডিংটির রক্ষণাবেক্ষণ এবং বাসিন্দাদের সকল সুবিধা নিশ্চিত করা। কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয় ভোটের মাধ্যমে, আর সভাপতির তত্ত্বাবধানে থাকে একজন ম্যানেজার। এই ম্যানেজার বিল সংগ্রহ থেকে শুরু করে লিফট, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, ইন্টারনেট বিল পরিশোধ পর্যন্ত সবকিছু তদারকি করেন। এজন্য তাকে একটি আলাদা রুম এবং মাসিক বেতনও প্রদান করা হয়।
প্রথমদিকে, ম্যানেজার তার দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করছিলেন। বাসিন্দাদের মাসিক বিল, বাজার সদাই, নিরাপত্তা এবং লিফট রক্ষণাবেক্ষণ সবই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হচ্ছিল। ম্যানেজারের ব্যবহারও বেশ ভদ্র ছিল, এবং বাসিন্দারা তাকে পছন্দ করত। সবাই শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করছিল, আর তারা ম্যানেজারের প্রতি আস্থা রাখতে শুরু করেছিল।
কিন্তু কিছুদিন পরই ম্যানেজারের মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যেতে থাকে। ধীরে ধীরে তিনি ক্ষমতাকে নিজের সুবিধার জন্য ব্যবহার করতে শুরু করেন। ম্যানেজার ভাবতে শুরু করেন যে, তিনিই এই অ্যাপার্টমেন্টের চূড়ান্ত কর্তৃত্ব। প্রথমে মৃদু হুমকি দিয়ে শুরু হলেও, পরে তিনি প্রকাশ্যে বলতেও শুরু করেন, “আমি তোমাদের বিদ্যুৎ দিই, পানি দিই। যদি আমার কথা না শোন, সব বন্ধ করে দেবো।” এভাবেই শুরু হয় তার শাসনের এক নতুন অধ্যায়।
প্রথমদিকে বাসিন্দারা বিষয়টি খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। তাদের ধারণা ছিল, ম্যানেজার হয়তো একটু কঠোর শাসন করছেন, তবে তার আসল উদ্দেশ্য বাসিন্দাদের ভালো করা। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা বুঝতে পারে, ম্যানেজারের এই শাসন সীমা ছাড়িয়ে গেছে। বাসিন্দাদের মধ্যে অস্থিরতা বাড়তে শুরু করে, কারণ ম্যানেজার শুধু বিদ্যুৎ এবং পানি বন্ধ করার হুমকি দিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি, বরং যারা তার বিরুদ্ধে কথা বলার চেষ্টা করছিল, তাদেরও সরাসরি হুমকি দিতে শুরু করেন।
এছাড়াও ম্যানেজারের সঙ্গে এক মাস্তানের সখ্যতা গড়ে ওঠে, এবং সেই মাস্তানের ছত্রছায়ায় তার ক্ষমতা বাড়তে থাকে। ম্যানেজার প্রতিদিন আরও স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। অনেক বাসিন্দা তার বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলে তাদের উপর শারীরিক এবং মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। এতে অনেকেই ভয়ে চুপ করে যায়।
অ্যাপার্টমেন্টের কিছু সাহসী বাসিন্দা একদিন একত্র হয়ে ম্যানেজারের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে বুঝতে পারে যে, ম্যানেজার যদি এইভাবে তাদের উপর অত্যাচার করতে থাকে, তবে তাদের ভবিষ্যত আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, ম্যানেজারকে তার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে হবে।
প্রথমে তারা ম্যানেজারের বিরুদ্ধে বিল্ডিং কমিটিতে অভিযোগ জানায়। কিন্তু ম্যানেজার তার ক্ষমতা ব্যবহার করে সেই অভিযোগগুলো ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। পরিস্থিতি ক্রমে জটিল হতে থাকে, বাসিন্দারা দমে না গিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলে। বিক্ষুব্ধ বাসিন্দাদের হাতে চাপে পড়ে ম্যানেজার শেষমেশ অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে পালিয়ে যায়। তবে পালানোর আগে সে অনেক ঝামেলা করে যায়।
বাসিন্দারা এরপর সবাই মিলে নতুন ম্যানেজার নিয়োগ দেয়। নতুন ম্যানেজার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমেই যখন বাজার সদাই করতে যায়, তখনই চমকপ্রদ ঘটনা সামনে আসে। স্থানীয় দোকানদারেরা জানায়, আগের ম্যানেজার তাদের থেকে লক্ষ লক্ষ টাকার জিনিস বাকিতে নিয়ে গেছে। এই বিপুল পরিমাণ টাকা পরিশোধ না করলে তারা আর কোনো পণ্য সরবরাহ করবে না।
এরপর আরও বিপত্তি ঘটে, যখন বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন এসে জানায় যে, বিদ্যুতের বিলও বহুদিন ধরে বাকি আছে। তারা বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়ার জন্য চলে আসে। বকেয়া বিদ্যুৎ বিল না পরিশোধ করলে পুরো বিল্ডিং অন্ধকারে ডুবে যাবে। নতুন ম্যানেজার এবং বাসিন্দারা এ ঘটনার জন্য কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিল না। তারা হঠাৎ করেই নিজেদের গভীর সংকটে আবিষ্কার করে।
অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দারা এখন অন্ধকার, পানির অভাব এবং বাজারের পণ্য সংকটের মুখে পড়ে। তাদের জীবনযাত্রা দারুণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যায়। তারা দিনের পর দিন আধপেটে অন্ধকারে বসবাস করতে বাধ্য হয়। আর এই সুযোগে আগের ম্যানেজারের কিছু অনুগত ব্যক্তি, যারা এখনো অ্যাপার্টমেন্টে রয়ে গেছে, তারা গোপনে ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা বাসিন্দাদের মধ্যে গুজব ছড়ায়, “আগের ম্যানেজারই ভালো ছিলেন। তার বিকল্প কেউ হতে পারবে না।”
এদিকে, পালিয়ে থাকা ম্যানেজার গোপনে তার অনুসারীদের ফোনে বলে, “আমি পদত্যাগ করিনি, আমাকে ষড়যন্ত্র করে সরানো হয়েছে। শীঘ্রই আমি ফিরে আসব, তোমরা ধৈর্য ধরো।” তার অনুসারীরা ভেতরে ভেতরে নতুন ম্যানেজারকে সরিয়ে আগের ম্যানেজারকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে থাকে।
নতুন ম্যানেজার সমস্ত ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। তিনি বাসিন্দাদের আশ্বস্ত করেন যে, ধৈর্য ধরে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে, একদিন তারা এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাবে এবং আবার শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারবে।
নতুন ম্যানেজার দ্রুত ব্যবস্থা নিতে শুরু করেন। তিনি দোকানদারদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে কিছু টাকা শোধ করতে সক্ষম হন। বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গেও কথা বলে একটি সময়সীমা আদায় করেন, যাতে তারা কিছু সময়ের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ চালিয়ে যেতে পারে।
অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দারা কিছুটা স্বস্তি পেলেও, এখনও অনেক কাজ বাকি। তবে নতুন ম্যানেজারের প্রতি তাদের আস্থা বাড়তে থাকে, এবং ধীরে ধীরে অ্যাপার্টমেন্টে আবারও স্থিতিশীলতা ফিরে আসে।
ধীরে ধীরে অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দারা একত্রিত হয়ে সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে শুরু করে। সবাই মিলে চাঁদা তুলে বাকি থাকা বিলগুলো পরিশোধ করে। দোকানদারদের সঙ্গে আবারও সম্পর্ক গড়ে ওঠে, এবং বাজার সদাই স্বাভাবিকভাবে শুরু হয়। বিদ্যুৎ, পানি, ইন্টারনেট—সবকিছু আবারও সচল হয়, আর বাসিন্দাদের মনে যেন নতুন আশার আলো ফুটে ওঠে।
নতুন ম্যানেজার তার সততা এবং নিষ্ঠার মাধ্যমে বাসিন্দাদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন। বাসিন্দাদের মধ্যে আবারও ঐক্য ফিরে আসে, এবং একে অপরের প্রতি সহযোগিতার মনোভাব আরও মজবুত হয়। আগের ম্যানেজারের শাসনের ছায়া ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে। মেসের প্রতিটি সদস্য উপলব্ধি করে, একসাথে কাজ করলে তারা যেকোনো সমস্যার সমাধান করতে পারে।
সবচেয়ে বড় যে শিক্ষা তারা পেয়েছে তা হলো, কোনো ব্যক্তি বা একক ক্ষমতাধারী যদি দায়িত্বের অপব্যবহার করে, তবে সঠিক সময়ে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সেই অন্যায়কে প্রতিহত করা সম্ভব। অতীতের সব সংকট কাটিয়ে, এখন তারা একটি সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা নতুন স্বপ্ন বুনছে, যেখানে সবার অংশগ্রহণ এবং সবার মঙ্গলের জন্যই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এই সংকট তাদের শিখিয়েছে যে, সত্যিকারের শক্তি মানুষের ঐক্যে এবং সততার সঙ্গে কাজ করার মানসিকতায়। এই অন্ধকারময় অধ্যায় পেরিয়ে তারা উপলব্ধি করেছে, কোনো প্রতিবন্ধকতাই স্থায়ী নয়, আর প্রতিটি সংকটের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে নতুন দিনের সম্ভাবনা।