শামসুর রাহমান : সমন্বিত প্রাচুর্যের উত্তরাধিকার

0
65

হাসান আল আব্দুল্লাহ

একজন আপাদমস্তক নাগরিক কবি শামসুর রাহমান কবিতায় বিচিত্র বিষয় স্পর্শ করেছেন। মূলত যে কোনো বিষয়কে কবিতা করে তোলা যায় এমন প্রমাণ খুঁজতে হলে অনায়াসে রাহমানের রচনাসমুদ্রে ঝাঁপ দেবার বিকল্প নেই। রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের পরে কবিতায় বহুমুখী বিচরণের ভেতর দিয়ে নিজস্ব মানদণ্ড স্থাপনের যে সাহস তিনি দেখিয়েছেন তা হয়ত আরো অনেকগুলো বছর ধরে কবিদের অনুকরণীয় স্বভাব হয়ে থাকবে। উল্লিখিত দুই কবির মতোই বিচিত্র বৈভব তৈরির পাশাপাশি অসংখ্য অজস্র কবিতা লিখেছেন তিনি। কবিতার ভেতর দিয়ে বলতে চেয়েছেন জীবনের সমস্ত কথা; একটি দেশের সংগ্রাম-স্বাধীনতা, রাজপথের মিছিল, খেলনার দোকানে ভিখিরির আকাঙ্ক্ষা, ভুলে যাওয়া বাচ্চুর আর্তনাদ, এ্যাগামেমননের মতো জনক হত্যা, মানুষের নিয়মিত আর্তচিৎকার সহ পারিপার্শ্বিকতার এমন কোনো বন্যা নেই যা উঠে আসেনি তাঁর কবিতায়। একদিকে যেমন কবিতাকে সহজতর করে তুলেছেন, অন্যদিকে নির্মাণের কৌশলগত অভিযোজনের মাধ্যমে এর উৎকর্ষের মাত্রাও বাড়িয়ে দিয়েছেন। ভাষার মতোই ছন্দও তাঁর হাতে তাই বিচিত্র পথে প্রসারিত হয়েছে। সম্ভবত তিনিই সেই বিরলপ্রজ কবি যিনি কথা-বলার-মতো-করে কবিতা লিখেছেন, অথচ ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে রেখেছেন ছন্দের শক্ত গাঁথুনি। কবিতায় কী সহজ ভাবে, স্রোতের মতো, পালের শব্দের মতো বলে গেছেন!

স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা─
স্বাধীনতা তুমি
শহিদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত স্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।
(স্বাধীনতা তুমি)

অথচ মাত্রাবৃত্তের ছয়ের চাল-এর নিখুঁত ব্যবহারের সাথে অক্ষরবৃত্তও কোনো রকম জটিলতা ছাড়া পরতে পরতে জড়িয়ে গেছে। একদিকে যেমন বাংলাভাষায় স্বাধীনতার চিন্তাটিকে সহজ করে সবার হাতে তুলে দেবার দায়িত্ব পালন করেছেন, অন্যদিকে কত্থকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে আধুনিক বাংলার ইতিহাস তুলে এনে এই ছোট্ট কবিতাটির মাধ্যমে তিনি অসামান্য চূড়ায় পৌঁছে গেছেন। আদতে শিল্প তো তাই, তুলির আঁচড়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বলা যায় না ওর চূড়া কোথায় গিয়ে ঢেকবে। সৃষ্টি যখন পরিপূর্ণ পাখা মেলে দেয় তখন তার তুলনা একমাত্র সে-ই; দাঁড়িয়ে থাকে জ্বলজ্বলে সূর্যের মতো নিজস্ব মহিমায়।

শামসুর রাহমানের অন্য একটি কবিতা “কবর খোঁড়ার গান” যা মাত্রাবৃত্তের সাত মাত্রার চালে বা মন্দাক্রান্তায় লেখা, অতিপর্বে রাখা হয়েছে পাঁচ। ধ্রুপদী সংখ্যা তিন এর সমন্বিত প্রয়োগে একটি কবর খুঁড়ে চলেছে তিন বন্ধু; যুক্তি কৌশল পাণ্ডিত্য বর্বরতা ও মানবেতিহাসের শিকড়-বাকড় ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন তারা।

ধারি না ধার কোনো মহোদয়ের,
আমরা তিনজন খুঁড়ছি গোর।
নিপুণ বিদ্রুপে অন্তহীন
দূরের আসমানে জ্বলে দিনার।

দূরের আসমানে জ্বলে দিনার।
কোদালে অবহেলে উপড়ে আনি
মাটির ঢেলা আর মড়ার খুলি।
শরিফ কেউকেটা কী ক’রে চিনি?
(কবর খোঁড়ার গান)

যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া হয়, শব্দের বন্ধনে যে মন্দির বা বাগান বা জঙ্গল বা সমুদ্র একজন কবি গড়ে তোলেন যে “কবর খোঁড়ার গান” মূলত তারই প্রতীক, তবে এ-ও বলা অসংগত হবে না খোঁড়াখুঁড়ির এই আয়োজনও দুরন্ত এক নেশা, যার থেকে খাঁটি আর কিছু নেই। “আমরা তিনজন খুঁড়ছি গোর।/ হয়ত রুটি আর গোলাপ-কুঁড়ি/ যুগ্মতায় জ্বলে চাওয়া-পাওয়ায়,/নেশার মতো খাঁটি নেই কিছুই।” অতএব খোঁড়ার কাজ চলতেই থাকে।

বলা অমূলক নয় যে ছন্দের এমন কোনো পথ নেই যেখান দিয়ে শামসুর রাহমান হাঁটেননি। এমনকি চলতে চলতে নতুন নতুন পথও তৈরি করেছেন। প্রতিষ্ঠিত তিন ছন্দেই ভাষাকে দোলানোর খেলা তিনি অব্যাহত রেখেছেন। অমিল মুক্তক তাঁর হাতে এনে দিয়েছে নতুন দ্যোতনা। অন্যদিকে ছন্দের আদিরূপ, লাইনে লাইনে সমান মাত্রার পর্বও গঠন করেছেন প্রায় নিয়মিত। তাঁর কবিতায় ছন্দের স্বতন্ত্র ব্যবহার নিম্নরূপ:

স্বরবৃত্ত

কথার ছলে স্বরবৃত্ত দীপ্তি এনেছে রাহমানের কবিতায়। এর দাড়ি কমা সেমিকোলনগুলো হয়ে উঠেছে অনায়াস লব্ধ, তাৎপর্যময়। এসেছে শ্লেষ, নিয়ম ভাঙার আমন্ত্রণ, অমিল মুক্তক ও অন্ত্যমিলের নিপুণতা।

ক.
কারুর দিকে হাত বাড়ালেই হাত সরে যায়
দুঃখভেজা মেঘ-আড়ালে
যখন-তখন
মনের আপন ঘাঁটি ভীষণ প্রকম্পিত।
এখন আমি কারুর কোথাও যাবার কথা
শুনলে হঠাৎ চমকে উঠি।
(এখন আমি)

খ.
ছিলাম প’ড়ে কাঁটাতারে বিদ্ধ হ’য়ে
দিন-দুপুরে,
রাত-দুপুরে, মানে আমি সব দুপুরে
ছিলাম প’ড়ে!
বাঁচতে গিয়ে চেটেছিলাম
রুক্ষ ধুলো; জব্দ নিজের কষ-গড়ানো
রক্তধারায়।
(ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা)

গ.
হঠাৎ দেখি রেখেছি মুখ
গন্ধভরা রেশমি ঝোপে;
মত্ত আছি
যমজ ঘোড়ায় সওয়ার হ’য়ে।
যুগল টিলা মুঠোয় কাঁপে
অন্ধকারে।
(ময়ূরগুলো)

ঘ.
ড্রইংরুমের দেয়াল-জোড়া নানা শ্রেণীর বই;
মুগ্ধতাকে বশে রাখি, হারায় মনের খই।
হঠাৎ আবার কথা জোটে প্রাণ খুলে ফের হাসার,
বিশ্লেষণে তফাত ফোটে সোনা এবং কাসার।
(ছড়ার আদলে)

ঙ.
অকথ্য এক অন্ধকারে মগ্ন আমি
খুপরিটাকে আঁকড়ে ধরে;
বাঁচার নেশা অদ্যাবধি বেশ ঝাঁঝালো,
তাই তো টিকি এক শহরে।
(অকথ্য এক অন্ধকারে)

কবিতাগুলো স্বরবৃত্তে রচিত হলেও এদের অন্তরঙ্গ বুননের তারতম্যে প্রত্যেকেই আলাদা। তাছাড়া স্তবক বিন্যাসের একটি চমৎকার খেলাও রয়েছে। আছে শব্দ ব্যবহার ও প্রক্ষেপণের তীক্ষ্ণতা। তাই, একদিকে যেমন এরা সাদামাটা অন্যদিকে গাম্ভীর্যপূর্ণ। প্রথম তিনটি উদাহরণই অমিল মুক্তকের, কিন্তু চতুর্থ ও পঞ্চম কবিতা স্বরবৃত্তের ঐতিহ্যিক গুণাগুণ ঠিক রেখে দুই ধরনের অন্ত্যমিলে রচিত।

বুকের ভেতর মেঘের মতো
একটা কিছু বেড়ায় ভেসে,
অনেক আগে দেখা কোনো
গাছের পাতা স্বপ্ন হয়ে
কাঁপতে থাকে চোখের বনে─
এই কি আমার চাওয়া?

যখন তুমি কাছে আসো,
নগ্নতাকে প্রখর জ্বেলে
আমার পাশে শুয়ে থাকো,
শূন্যতারই ছায়া দেখি।
একলা মনে প্রশ্ন করি─
একেই বলে পাওয়া?
(কোনো একজনের কথা ভেবে)

স্তবক শেষে মিলের ব্যবহার, কিছুটা ছড়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও পুরোপুরি আধুনিকতার স্বাদ জড়িয়ে আছে এর শাখায় শাখায়। তবে ছড়ার কাজেও তিনি আপত্তি করেননি। যেমন,

মিশমিশে ঘোর অন্ধকারে
কনুই দিয়ে ধাক্কা মারে
রহিম পড়ে রামের ঘাড়ে,
কেউ বা দেখে চুপিসারে
অন্য কারুর জায়গা কাড়ে,
পাচ্ছি তা টের হাড়ে হাড়ে।
লাইন থেকে সরছি ক্রমে সরছি।
(লড়ছি সবাই)

এ যেন মিল প্রয়োগের এক প্রতিযোগিতা, যেমন লাইনে দাঁড়ানো অসংখ্য মানুষ। তবুও ক্রমশ সেই লাইন থেকে সরছি, ঝরেও পড়ছি আমরা এবং ভাঙছে আমাদের মিলিন শোভাযাত্রা।

মাত্রাবৃত্ত

স্বরবৃত্তের চেয়ে অনেক বেশি কবিতা তিনি লিখেছেন মাত্রাবৃত্ত ছন্দে; বিশেষত এই ছন্দের ছয় মাত্রার চাল তাঁর হাতে ফুলের মতো বিকশিত হয়েছে। সমিল, অমিল, লাইনে সমান ও অসমান পর্ব ইত্যাদি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে এগিয়েছে মাত্রাবৃত্তে তাঁর পদচারণা।

ক.
শ্রাবণের মেঘ আকাশে আকাশে জটলা পাকায়
মেঘময়তায় ঘনঘন আজ একি বিদ্যুৎ জ্বলে।
মিত্র কোথাও আশেপাশে নেই, শান্তি উধাও;
নির্দয় স্মৃতি মিতালি পাতায় শত করোটির সাথে।

নিহত জনক, এ্যাগামেমনন্, কবরে শায়িত আজ।
(ইলেকট্রার গান)

খ.
সম্মুখে কাঁপে অমোঘ সর্বনাশ।
দিনের ভস্ম পশ্চিমে হয় জড়ো,
অনেক দূরের আকাশের গাঢ় চোখে
রাত্রি পরায় অতল কাজল তার।
এমন নিবিড় স্মৃতি-নির্ভর ক্ষণে
বলি কারো নাম, হৃদয়ের স্বরে বলি।
জ্বলি অনিবার নিজেরই অন্ধকারে।
(নির্জন দুর্গের গাথা)

গ.
গলায় রক্ত তুলেও তোমার মুক্তি নেই।
হঠাৎ-আলোয় শিরায় যাদের আবির্ভাব,
আসবেই ওরা ঝড়ের পরের পাখির ঢেউ
তাদের সুদূরে ফিরিয়ে দেবার মন্ত্র যদি
জানতে, তবে কি প্রতি মুহূর্তে ব্যর্থতার…
(আত্মজীবনীর খসড়া)

ঘ.
তখন কাছ থেকে বুকের ওঠা-নামা,
ঠোঁটের নড়া আর চোখের ঝল্কানি
দেখেছি তন্ময় এবং তোমাকেই
ব্যাকুল পান করে, কেটেছে সারা বেলা।
(নিভিয়ে এক ফুঁয়ে)

চারটি কবিতাই মাত্রাবৃত্তে লেখা। প্রথম তিনটি ছয় মাত্রার এবং শেষেরটি সাত মাত্রার চালে। কোনোটিতেই অন্ত্যমিল রাখা হয়নি, অর্থাৎ এরা অমিল মাত্রাবৃত্তের কবিতা। তবে প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা। প্রথম কবিতায় তিনটি করে পর্ব ও দুই মাত্রার অতিপর্ব, দ্বিতীয় কবিতায় দু’টি করে পর্ব ও দুই মাত্রার অতিপর্ব, তৃতীয় কবিতায় দু’টি করে পর্ব ও পাঁচ মাত্রার অতিপর্ব এবং চতুর্থ কবিতায় দু’টি করে পর্ব রাখা হয়েছে। এইভাবে লাইনে পর্ব সংখ্যা ও অতিপর্বে মাত্রা সংখ্যা বাড়িয়ে কমিয়ে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিপর্বকে একেবারেই বর্জন করে কবিতায় নানা রকম দ্যোতনার সৃষ্টি করা হয়েছে।

আরো উদাহরণ:

ঙ.
নব্য যুবা নিত্য বলে শুনি
বোধি-দীপ্ত জীবন-ঘন ভাষা।
অবাক হ’য়ে ভাবেন পিতামহ:
পুরোনো ঘরে এ-কার যাওয়া আসা।
(টানাপড়েন)

পাঁচ মাত্রার পর্ব। অতিপর্বে মাত্রা সংখ্যা দুই এবং সমিল।

চ.
দান্তের মতো ঘুরি জনপদে একা;
সাঁকো আছে ঠিক, জলও বয়ে যায় নিচে।
এখানে ওখানে ব্যাকুল দৃষ্টি রাখি,
কিন্তু কোথায় আমার বিয়াত্রিচে।
(দৃশ্যপট, আমি এবং অনেকের)

ছয় মাত্রার পর্ব। অতিপর্বে মাত্রা সংখ্যা দুই এবং সমিল। লক্ষণীয়, “জলও” শব্দটিকে বানানগত ভাবে উচ্চারণ করলে তিন মাত্রা দিতে হয়, কিন্তু কবিতার প্রয়োজনে কবি “জলো” উচ্চারণ করেছেন।

ছ.
যখন আমার ভাবনা মরণ বেলা-অবেলায়
ছন্দ-মিলের চুমো খেয়ে হয় সঙ্গীতময়,
যখন হৃদয়ে গীতবিতানের পাতা নেচে ওঠে,

সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।
(সুচেতা তখন)

ছয় মাত্রার চাল। কোনো অতিপর্ব ছাড়াই লাইনে তিনটি করে পর্ব, কিন্তু “তোমার মুখ”-কে পাঁচ মাত্রার অতিপর্ব হিসেবে জুড়ে দেয়া হয়েছে। এগারোটি পূর্ণ পর্ব বুনে যাবার পর পঙ্‌ক্তি শেষে এসেছে পাঁচ মাত্রার অতিপর্ব। এবং কবিতাটির মোট তেরোটি স্তবকেই ধরা হয়েছে একই রীতি। সম্ভবত এ ধরনের বুনন বাংলা ভাষায় এই প্রথম। অথচ কি চমৎকার গদ্যের মতো পড়ে যাওয়া যায়। গদ্য ও পদ্যের এই অভিনব মিলন নির্ধারক কবিতাটির দশম স্তবকটি পড়া যাক।

যখন আমিও ক্রোশ ক্রোশ পথ পেরিয়ে ক্লান্ত
আবার আমার উঠানে দাঁড়াই, যখন চকিতে
চরাচর বিসমিল্লা খানের সান্দ্র সানাই,
সুচেতা তখন মনে পড়ে মুখ, তোমার মুখ।
(সুচেতা তখন)

এখানেই কবির আসল সার্থকতা। কবিতাকে গদ্যের মতো পড়ে গেলেও তার মাঝে ছন্দের একটি সুস্পষ্ট বুনন যে আছে তা গুরুত্ব দিয়ে যাচাই না করলে বোঝার উপায় থাকে না।

জ.
ঘরে ফিরে গিয়ে যখন শরীর থেকে নীলাকাশ
চুপে নিয়েছিলে খুলে,
তখন হঠাৎ একাকী প্রহরে পড়েছিলো টান
তোমার মর্মমূলে।
(উৎসব-রাতে হঠাৎ)

ছয় মাত্রার চালে চারপর্বের পঙ্‌ক্তি। দুই মাত্রার অতিপর্ব এবং সমিল।

ঝ.
শকুন-উকিল ঘোর ঠিকাদার
আর নিধিরাম সর্দার আর
হুজুরের জি-হাঁ হুঁকোবরদার
দৈব্য এবং বৈশ্য
ঘাঁটব আমার প্রাণ-নিংড়ানো
সাধের অনেক শস্য।
(কাদের জন্য)

ছয় মাত্রার পর্ব এবং সমিল। প্রথম পঙ্‌ক্তি সাত পর্বের হলেও দ্বিতীয় পঙ্‌ক্তি রচিত হয়েছে তিন পর্বে, অন্যদিকে পঙ্‌ক্তি শেষে তিন মাত্রার অতিপর্ব রাখা হয়েছে।

ঞ.
লোকটার নেই কোন নামডাক।
তবু তার কথা অষ্টপ্রহর
ভেবে লোকজন অবাক বেবাক!
লোকটার নেই কোনোখানে ঠাঁই।
জীবন লগ্ন পথের ধুলায়,
হাতে ঘোরে তার অলীক লাটাই।
(একজন লোক)

লাইনে ছয় মাত্রার দু’টি করে পর্ব এবং সমিল। প্রথম পঙ্‌ক্তি দুই পর্বের হলেও দ্বিতীয় পঙ্‌ক্তি তৈরি হয়েছে চার পর্বে। কোনো অতিপর্ব রাখা হয়নি।

ট.
হয়ত কখনো আমার ঠান্ডা মৃতদেহ ফের খুঁজে পাবে কেউ
শহরের কোনো নর্দমাতেই;─সেখানে নোংরা পিছল জলের
অগুনতি ঢেউ
খাবো কিছুকাল। যদিও আমার দরজার কোণে অনেক বেনামি
প্রেত ঠোঁট চাটে সন্ধ্যায়, তবু শান্ত রুপালি স্বর্গ-শিশিরে স্নান করি আমি।
(রুপালি স্নান)

“স্বাধীনতা তুমি” কবিতার মতোই ছয় মাত্রার এই মাত্রাবৃত্তের মুক্তকটি শামসুর রাহমানীয় আবেশ ছড়িয়ে দেয়। স্বাভাবিক পাঠে ছন্দের গুরুত্ব বোঝা না গেলেও, ছন্দের অপূর্ব গাঁথুনি কবিতাটিকে বলা বাহুল্য শক্তিশালী করেছে। এখানে “প্রধান হয়ে আছে [তাঁর] মনোলোক, যা অপার্থিব রোম্যান্টিক স্বপ্নেসৌন্দর্যে রাঙানো (আজাদ, ৪৩)।”

অক্ষরবৃত্ত

তাঁর সিংহভাগ কবিতাই রচিত হয়েছে অক্ষরবৃত্তে। এই ছন্দের বিভিন্ন শাখা যেমন মিত্রাক্ষর, অমিত্রাক্ষর, সমিল মুক্তক, অমিল মুক্তক এবং মুক্ত বা নঞ ছন্দে তাঁর নানামুখী বিচরণ কিংবদন্তী তুল্য। অন্তহীন পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে তিনি নিজস্ব একটি ভাষারীতিও উদ্ভাবন করেছেন, যা অনেকটাই সাধারণ পাঠকের কাছে ছন্দ-মাত্রা-অন্ত্যমিল-ছাড়া দৈনন্দিন গদ্যের উদাহরণ হিসেবে ধরা দিতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওইসব কবিতা ছন্দ-মাত্রার শক্ত বাতাবরণে উপস্থাপিত।

উদাহরণ:
মিত্রাক্ষর:

ক.
সেদিন হঠাৎ তাকে দেখে, সত্যি বলতে কী, গাটা
গুলিয়ে উঠল খুব, এমন প্রচণ্ড বিবমিষা
কখনো হয়নি আগে। অতি মনোহর রাম পাঁঠা
তাকে বলা যায় সহজেই। পালাতে চাইলে দিশা
মেলা ভার, …
(পাঁঠা সংকীর্তন)

খ.
আকাশ ভীষণ খাঁ-খাঁ, একরত্তি মেঘ নেই, শুধু
তরল আগুন গলে পড়ছে চৌদিকে। এই ধু-ধু
আকাশের দিকে চোখ রাখা দায়। হঠাৎ কখনো
জমে মেঘ; মনে হয়, হয়ত বা বৃষ্টি হবে ঘন,
হৃদয়-ডোবানো বৃষ্টি।
(অনাবৃষ্টি)

অমিত্রাক্ষর:
ক.
তুমি কি এখনো আসবে না? স্বদেশের পূর্ণিমায়
কখনো তোমার মুখ হবে নাকি উদ্ভাসিত, পিতা,
পুনর্বার? কেন আজও শুনি না তোমার পদধ্বনি?
এদিকে প্রাকারে জমে শ্যাওলার মেঘ, আগাছার
দৌরাত্ম্যের বাগানে বাড়ে প্রতিদিন। সওয়ারবিহীন
ঘোড়াগুলো আস্তাবলে ভীষণ ঝিমোয়, কুকুরটা
অলিন্দে বেড়ায় শুঁকে কত কী-যে, বলে না কিছুই।
(টেলেমেকাস)

খ.
এ-কথা নিশ্চয় তুমি কখনো ভুলেও বলবে না─
‘ভালোবাসতেই হবে’ এই মুচলেকা লিখে দাও,
বলে আমি ভন্ ভন্ করেছি তোমার চারপাশে
নিরালায়। বরং দিয়েছি স্বাধিকার তোমাকেই
আমাকে গ্রহণ কিংবা বর্জনের।…
(কেবল মৃত্যুই পারে)

সমিল মুক্তক:

ক.
আমার দু’চোখ বেঁধে রেখেছি প্রতিমা। তার রূপ
কেমন নিশ্চুপ
কানায় কানায় ভরা সরোবর। আমার হৃদয়ে ঢেউ ওঠে,
যখন অধরে তার ফোটে
পারস্য গোলাপ-কুঁড়ি। প্রায়শ কুড়াই অসামান্য স্মৃতিকণা
নীরব সাধনে, ভুলব না
তাকে ভুলব না কোনো দিন।
আছে তো চোখেই বাঁধা, তবু কেন হয়ে যাই আর্ত ভায়োলিন?
(আমার দু’চোখে বেঁধে)

খ.
লোকটাকে বহুকাল ধরে ওরা ভীষণ পীড়ন
করছিল; ওর ত্রস্ত চক্ষুদ্বয় সূর্যের কিরণ
দেখতে পারবে কিনা পুনরায়, এমন সন্দেহ মনে উঁকি
দিচ্ছিল আমার, তাই ঝুঁকি
নিয়ে কাছে গিয়ে বলি, আসলে সে নয়
দোষী, মানে ধৃত অর্ধমৃত এই লোকটার ভুল পরিচয়
ফেলেছে বিপদে তাকে।…
(প্রবাদকে মিথ্যে করে দিয়ে)

গ.
আমাদের বারান্দায় ঘরের চৌকাঠে
কড়িকাঠে চেয়ারে টেবিলে আর খাটে
দুঃখ তার লেখে নাম। ছাদের কার্নিশ, খড়খড়ি
ফ্রেমের বার্নিশ আর মেঝের ধুলোয়
দুঃখ তার আঁকে চকখড়ি
এবং বুলোয়
তুলি বাঁশি-বাজা আমাদের এই নাটে।
(দুঃখ)

অমিল মুক্তক:

ক.
ঘোড়ার নালের মতো চাঁদ
ঝুলে আছে আকাশের বিশাল কপাটে, আমি একা
খড়ের গাদায় শুয়ে ভাবি
মুমূর্ষু পিতার কথা, যার শুকনো প্রায়-শব প্রায়-অবাস্তব
বুড়োটে শরীর
কিছুকাল ধরে যেন আঠা দিয়ে সাঁটা
বিছানায়।…
(জনৈক সহিসের ছেলে বলছে)

খ.
দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার।
পুড়ছে দোকানপাট, কাঠ,
লোহা-লক্কড়ের ¯ত‚প, মসজিদ এবং মন্দির।
দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার।
(তুমি বলেছিলে)

অক্ষরবৃত্তের মুক্তকই পরবর্তী সময়ে গদ্যছন্দ, মুক্তছন্দ বা নঞছন্দ নামে বিপুল পরিচিতি পায়। এই পর্বে শামসুর রাহমানের অবদান গভীর ভাবে চোখে পড়ার মতো। যদিও তিরিশের দশকেই এধরণের কবিতা প্রথম দেখা যায়, চল্লিশের আহসান হাবিব, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের হাত ধরে পঞ্চাশ, ষাট ও পরবর্তী সময়ে কাব্য বুননের এই ধারাটি কবিদের প্রধানতম বাহন হয়ে ওঠে। এবং এই রীতির সফল ব্যবহারে রাহমানকে বাংলা কাব্যাঙ্গনে নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করতে দেখা যায়। এ যেন কথা ও গদ্যের মাঝামাঝি একটি ভাষা যা শেষ পর্যন্ত তাঁর নিজস্ব বলেই মনে হয়। যেমন,

না, আমি বিলাপ করবো না তার জন্যে, যে আমার
নিজের একান্ত অংশ, স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ; যাকে আমি
দেখেছি উঠোনে হাঁটি-হাঁটি পা-পা হেঁটে যেতে
আনন্দের মতো বহুবার। যখন প্রথম তার
মুখে ফুটেছিল বুলি, কী যে আনন্দিত
হয়েছি সেদিন আমি;
(ডেডেলাস)

এখানে সব নিয়ম মেনেও নিয়ম না মানার একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কি সুন্দর জোড়ে-জোড় বিজোড়ে-বিজোড় মিলিয়ে গেছেন তিনি। এবং প্রথম তিনটি লাইন পুরোপুরি গদ্য বলে চালিয়ে দিলেও, “আনন্দের মতো বহুবার” শব্দবন্ধের ব্যবহারই শেষ পর্যন্ত উদ্ধৃত অংশটুকু যে কবিতা তা যথারীতি স্মরণ করিয়ে দেয়। আবার কখনো কখনো জোড়ে-জোড় বিজোড়ে-বিজোড় পুরোপুরি না মিলিয়ে তিনি যে কবিতা লেখেননি তা নয়। যেমন:

তুমি কি জেলাদার হ্যাট-কোট-পরা শাঁসালো বিদেশিকে দেখে
তোমার উরুদ্বয় ফাঁক করে দেবে নিমেষে?
আমি আমার আগুন উগরানো চোখ হ্যামলেটের মতো
এখন সরিয়ে নিচ্ছি বটে…
(গুড মর্নিং বাংলাদেশ)

শোবার ঘর পাচ্ছি, মুখ দেখবার
ঝকঝকে আয়না পাচ্ছি, হেঁটে বেড়ানোর
তকতকে হাসপাতালী করিডোর পাচ্ছি।
(দুঃস্বপ্নে একদিন)

নিয়মতান্ত্রিক ছন্দের বন্ধন কোথাও কোথাও শিথিল হয়েছে, এবং সে অর্থে উদ্ধৃত এই দু’টি কবিতা ছন্দের ত্রুটিমুক্ত নয় তা ঠিক, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত বুননে মুক্ত ও বদ্ধস্বর তথা যুক্ত ও বিযুক্ত বর্ণের সমন্বয়ে গঠিত শব্দমালার বৃত্তায়িত ব্যবহারে এ কবিতাও অন্যরকম দোলার সৃষ্টি করে। তবে এটাও বলা অমূলক নয় যে এইসব কবিতা লিখতে লিখতে কবি হয়ত নিজের অজান্তেই পুরোপুরি গদ্যে ঢুকে যান। যেমন,

হঠাৎ একদিন বারবেলায় এক প্রেস রিলিজ আত্মপ্রকাশ করল। নগরবাসীদের জন্যে এটা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। অনেকেই ব্যাপারটিকে অলক্ষুণে বলে  ঠাউরে নিল, যদিও মুখ ফুটে কেউ কিছু বলল না। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হল একটি কফিনের কথা। সেই কফিন নাকি প্রায়শই নজরে পড়ছে লোকজনের।(কফিন, দোলনচাঁপা এবং কোকিল)

সনেট

সনেটও যথারীতি টেনেছে শামসুর রাহমানকে। “মাতাল ঋত্বিক” কাব্যগ্রন্থ আদতে একটি সনেট সংকলন। সমিল, অমিল, পের্ট্রারকান, শেক্সপীয়ারিয়ান ধারার এমনকি কোনো ধারার-ধার-না-ধরা সনেটে পূর্ণ হয়েছে গ্রন্থখানা। অন্যদিকে জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি যেমন ছন্দের নানা রকম ব্যবহারের কথা ভোলেননি তেমনি সনেট আঙ্গিকটির কাছেও ফিরে ফিরে এসেছেন, যার সাক্ষ্য বহন করে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত তাঁর বইগুলো।

জমিনের বুক চিরে লাঙলের পৌরুষে কৃষক
শস্য তোলে কায়ক্লেশে, রকমারি রঙিন আনাজে
ঋদ্ধ করে গৃহকোণ। মাঠ ছেড়ে চলে আসে সাঁঝে;
কোনো কোনো জ্যোৎস্না রাতে কী ব্যাকুল করে সে পরখ,
শোঁকে ফসলের ডগা। কিছুতেই ভাবে না নরক
নিজের কুটিরটিকে, বিবির পাশেই শোয়, মাঝে
উদম বাচ্চার ঘুম, সারাদিন হাড়ভাঙ্গা কাজে
কাটে, রাতে স্বপ্ন দেখে পঙ্গপাল নামে বেধড়ক।

কবিও কর্মিষ্ঠ চাষি, রোজ চষে হরফের ক্ষেত
নুয়ে-নুয়ে, কখনো কখনো খুব আতসি খরায়
জলসেচে মগ্ন হয়, বোনে কিছু বীজ অলৌকিক।
মাটি ফুঁড়ে চারা জাগে তখলিফে আগাছা নিড়ায়
কতদিন, ঘ্রাণ নেয় স্তবকের উপমাসমেত;
কখনো কখনো পোকা শায়েরকে সাজা দেয় ঠিক।
(জমিনের বুক চিরে)

অক্ষরবৃত্তের আঠারো মাত্রার এই সনেটটিতে “সতর্ক শব্দ চয়নের দ্বারা প্রতি লাইনে আঠারো অক্ষর সংযোজিত হয়েছে (আব্দুল্লাহ, ৪৯)।” কবিকে একজন কর্মিষ্ঠ চাষির সাথে তুলনা করে পের্ট্রারকান ধারায় রচিত এই সনেটটি রাহমানীয় সফলতার কথা তুলে ধরে। বস্তুত, প্রতিদিন “নুয়ে-নুয়ে” শামসুর রাহমান আমৃত্যু শব্দের চাষ করে গেছেন একান্ত নিমগ্নতায়।

২.
কবিতায় শামসুর রাহমানের আসল সার্থকতা কি তাঁর প্রাচুর্যে না স্বদেশ সংলগ্নতায়? নাকি গদ্যের কাছাকাছি ভাষা নির্মাণে? আমরা তো জানি যে তাঁর “বিষয় ও উপাদান সংগ্রহে তিনি নাগরিক ও বিজড়িত জীবনজটলা ও সংশ্লিষ্ট পারিপার্শ্বের ওপর নির্ভরশীল, ফলে তাঁর প্রতিফলনের সমর্থক উপকরণগুলো শহুরে এবং তাঁর কাব্যের পটভূমিও অনেকাংশেই শহর (রহমান, ৩১২)।” অর্থাৎ তিনি আপাদমস্তক নাগরিক কবি। কিন্তু এ কথাও সত্য যে প্রত্যেক আধুনিক কবিই নাগরিক কবি। শহর বা শহর কেন্দ্রীকতাই নাগরিক বা শহুরে কবির একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয়। ভাষার আধুনিকায়নও গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে পশ্চাদমুখিতা এবং প্রতিক্রিয়াশীলতাকে ছুঁড়ে ফেলে প্রগতির দিকে দ্রুত হেঁটে যাওয়াও একজন আধুনিক কবির দায়িত্বের ভেতর পড়ে। ফলত চল্লিশের আহসান হাবিব হয়ে ওঠেন আধুনিক। সেই ধারাকে অব্যাহত ভাবে পঞ্চাশে সচল রাখেন শামসুর রাহমান। তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য প্রধান কবি─যেমন আল মাহমুদ, শহিদ কাদরী, শক্তি চট্টপ্যাধ্যায়─থেকে তাঁর মূল যে পার্থক্য তা হলো তাঁর ঐকান্তিক স্বদেশ সংলগ্নতা। বাংলার ইতিহাসের সাথে তাঁর কবিতা এমন ভাবে সেঁটে গেছে যে সংগ্রামী বাংলাদেশ ও শামসুর রাহমানকে আলাদা করার উপায় নেই। পাশাপাশি, তাঁর “কবিতায় [অন্য] এক নতুন বাঙলার উত্থান লক্ষণীয়। প্যাস্টোরাল সৌন্দর্যখচিত শোভাময় বাঙলা হারিয়ে যাচ্ছে কালের আক্রমণে, উঠে আসছে এক নতুন বাংলা, যা শহরমুখী অসুন্দর ঝাঁঝালো নতুন (আজাদ, ৮২)।” এই ঝাঁঝালো নতুন বাংলাকে দীপ্তিময় করে তোলে তাঁর আলোকিত বর্ণমালা। বোদলেয়ার যেমন অশুভ ও তথাকথিত অসুন্দরের মাঝে খোঁজেন পরিবর্তিত সুন্দরের রূপ, রাহমানও দেশীয় ঢংয়ে কিছুটা শ্লেষ মিশ্রিত কণ্ঠে “উদ্ভট উটের পিঠে” দেখেন ক্ষয়িত সৈন্দর্যের নতুন আশ্রয়─যদিও তা তাঁর কাম্য নয়। “চিতার চোখের মতো চাঁদ” দেখে যদিও তিনি মুষড়ে পড়েন, তথাপি “দুঃখিনী বর্ণমালা”-কে “নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে” আপন সত্তার মাঝে দেখেন সতত সরব। প্রত্যাশার বিপুল পতাকা উড়িয়ে তিনি “আমাদের ব্যক্তি ও সমষ্টির যাবত অনুভূতিকে … প্রত্যক্ষ করেন (হক, ১৪)।” সমকালে রাষ্ট্রীয় উত্থান-পতনের প্রতিটি বাঁককে যেমন অক্ষরবন্দী করতে সচেষ্ট হন, তেমনি মা-মাটি-মার্তৃভাষার পক্ষে রাখেন তাঁর জোরালো উচ্চারণ। অতএব, যতোই বর্ণচোরা, যতোই হিংস্র হোক, শেষ পর্যন্ত “মানুষের হৃদয় গোলাপ ঘ্রাণ” পান করার কথা বলেন, “কেন না মানুষ তার হিংস্রতা কখনো/ কখনো হাসির খাপে পুরে পূর্ণিমার চিতাবাঘের মতন/ অত্যন্ত উজ্জ্বল হয় সাবলীলভাবে।” অর্থাৎ আধুনিকতার ম্রিয়মাণ অস্তিত্বে, মানুষের হিংস্রত্বের মাঝেও নতুন অনুধ্যান রচনার প্রয়াসে বুক বাঁধেন তিনি।

শামসুর রাহমান বর্ণনাশ্রয়ী কবি। একই বিষয়ে তাই তিনি লেখেন একাধিক কবিতা, কখনো কবিতার পর কবিতা। বিষয়কে কবিতার কেন্দ্রে রেখে দশদিক থেকে ভাষার বাণ তিনি নিক্ষেপ করে যান নিয়মিত। ফলে, তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে নিজস্ব প্রিজমে প্রতিফলিত তাঁরই সময়ের পরিপূর্ণ ইতিহাস। কখনো তা রূপ নেয় আত্ম-কথন বা আত্ম-সমালোচনায়। যেমন,

বাচ্চু তুমি, বাচ্চু তুই, চলে যাও চলে যা সেখানে
ছেচল্লিশ মাহুৎটুলীর খোলা ছাদে। আমি ব্যস্ত, বড়ো ব্যস্ত,
এখন তোমার সঙ্গে, তোর সঙ্গে বাক্যালাপ করার মতন
একটুও সময় নেই। কেন তুই মিছেমিছি এখানে দাঁড়িয়ে
কষ্ট পাবি?
(দুঃসময়ের মুখোমুখি)

নিজস্ব চৈতন্যের আধারে আটকে যাওয়া চেহারার দিকে তাকিয়ে এই স্বগতোক্তির ভেতর দিয়ে কবি হয়ত পরিবর্তিত বর্তমানের থেকে স্মৃতিকাতর অতীতকেই বেশি প্রশ্রয় দেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বর্তমান সংলগ্ন বাস্তবতাই জয়ী হয়। তাই স্মৃতি আঁকড়ে থেকে কষ্ট না পাওয়ার কথা বলেন মনের কিনারে জমে থাকা একতাল ভুলে যাওয়া সৈন্দর্যকে। এবং বর্তমানের স্বরূপ নির্ণয়ে মনোযোগী হন, কারণ তিনি এ-ও জানেন “স্তব্ধতা ঘুমন্ত বেড়ালের মতো গাঢ় আছে পড়ে” এখানেও, যদিও “দুঃখ তার লেখে নাম” অবিরাম।

অন্যদিকে পরিবর্তমান বাংলার প্রতি মুহূর্তের ইতিহাস এঁকে যান তিনি গ্রিক ট্র্যাজেডির সমান্তরালে। ডেডেলাস, ইকারুস, এ্যাগামেমনন্, টেলেমেকাসদের ডেকে আনেন জাতীয় জীবনের একেকটি ভয়ংকর অধ্যায়ের অনুপুঙ্খ বর্ণনায়। যেখানে “নির্দয় স্মৃতি মিতালি পাতায় শত করোটির সাথে” সেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের দেশে “নিহত জনক এ্যাগামেমনন্ কবরে শায়িত” যখন, এমন কঠিন সত্যকে ট্র্যাজেডির সমান্তরালে উপস্থাপন করা ছাড়া “দাবানলে পোড়া আর্ত হরিণীর” কিই বা করার থাকে। তাই “আসাদের শার্ট”, “ইলেকট্রার গান”, “স্বাধীনতা তুমি”, “বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়”, “একটি মোনাজাতের খসড়া”, “উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ” ইত্যাদি হয়ে ওঠে বাংলার ঐতিহাসিক দলিল। শামসুর রাহমান এখানেই আলাদা তাঁর সমসাময়িক কবিদের থেকে। তাছাড়া গদ্যের কাছাকাছি নিজস্ব একটি ভাষা নির্মাণেও তিনি যথেষ্ট সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তবে প্রাচুর্যের সম্প্রসারণ যেমন রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দকে, তেমনি শামসুর রাহমানকেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে উৎকর্ষের শিখরে পৌঁছাতে দেয়নি। তাই, তাঁর শেষ দিকের সিংহভাগ লেখাই একজন মহৎ কবির সায়াহ্নের শব্দমালা বিবেচনায় ঐতিহাসিক মূল্য পায়। এ-ও সত্য যে, তিনি সর্বত্র একটি গাম্ভীর্য ধরে রাখার চেষ্টা করে গেছেন শুরু থেকে শেষ অবধি। অতএব ছন্দের পরিকল্পিত ও সুচারু ব্যবহার, স্বদেশীয় ইতিহাসের সাথে সেঁটে যাওয়া, নিজস্ব ভাষা নির্মাণ, জাতীয় ট্র্যাজেডির সমান্তরালে মিথের প্রয়োগ, নাগরিক মননের গুরুত্বায়ন, প্রগতির সাথে একাত্মতা ঘোষণা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে শামসুর রাহমানের কবিতা বর্তমান ও ভবিষ্যতের পাঠকের কাছে অপরিহার্য। তাঁর কৃতিত্ব এখানেই।

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here