সন্‌জীদা খাতুন: সংস্কৃতি ও কর্মসাধনার পরম্পরা

0
65

মফিদুল হক

গুণীজনের জন্মদিনে শ্রদ্ধার অর্ঘ্য নিবেদনের প্রথাসিদ্ধ এক ধারা রয়েছে। তবে সে রকম কোনো কাঠামোতে সন্‌জীদা খাতুনের জীবন সাধনার পরিচয় তুলে ধরা দুঃসাধ্য, অথচ এমন পরিচয় প্রদান ছাড়া জন্মদিনে কীর্তিকথা ব্যক্ত করাও তো সম্ভব নয়। সম্ভব যে নয়, তার কারণ তিনি নিজেই তৈরি করেছেন, কোনো একক পরিচয়ে কিংবা বহুধা-বিস্তৃত বহুবিচিত্র কর্মের সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি দিয়েও মানুষটিকে বোঝা বা বুঝতে পারা সম্ভব নয়।

তাঁর প্রধান পরিচয় রবীন্দ্রসংগীতের সাধক হিসেবে, যিনি ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সুদীর্ঘকাল জুড়ে এর কাণ্ডারি এবং নির্মাতা। সেই সঙ্গে আমরা জেনেছি তাঁকে রবীন্দ্রসংগীতের পুরোধা ব্যাখ্যাতা হিসেবে, যেখানে তিনি অনন্য। সংগীতে পারঙ্গম শিল্পী তো বহুজন রয়েছেন, গুণী ব্যাখ্যাতাও মিলবে অনেক, তবে একই সঙ্গে সংগীতে সিদ্ধির উত্তুঙ্গ শৃঙ্গ-স্পর্শকারী ও গানের ভাবরূপ বিশ্লেষণ নবদিগন্ত-উন্মোচনকারী আর কেউ রয়েছেন কিনা সন্দেহ।

সেই কবে, একেবারে স্কুলজীবন থেকেই শুরু হয়েছে এমন অভিযাত্রা, যা ষাটের দশকে ছায়ানটের মাধ্যমে হয়ে ওঠে পূর্ববাংলার সাংস্কৃতিক জাগরণের রূপকার। এরপরও আমরা দেখি কত না বিস্তার, জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের মাধ্যমে দেশের নানা প্রান্তে তিনি বয়ে নিয়ে গেছেন গান, শিল্পের জাদুকাঠির স্পর্শে সমাজকে আলোড়িত ও জাগ্রত করার প্রয়াস। আবার ছায়ানট ঘিরে গড়ে উঠেছে নালন্দার মতো বিকল্প শিক্ষাদান প্রতিষ্ঠান, ব্রতচারী দর্শন ও সমষ্টিগত নৃত্যধারা পুনঃপ্রবর্তনের লক্ষ্যে নিয়োজিত রয়েছে আরেক প্রতিষ্ঠান, চলছে অটিস্টিক শিশুদের জন্য সুর-ছন্দ ও রঙের-চর্চার ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। এর পাশাপাশি তাঁর সংগীত, সংস্কৃতি ও ইতিহাসচর্চার পরিচয়বহ গ্রন্থগুলোর ফিরিস্তি নিলে আমাদের বিস্ময়ের অবধি থাকে না।

আরও এক পরম্পরা আমরা দেখি সন্‌জীদা খাতুনের জন্মেরও আগের ঘটনায়, ঢাকায় যে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন হয় তার অন্যতম পুরোধা ছিলেন তরুণ অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, সাথী ছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন প্রমুখ। নজরুল এই আন্দোলনের কথা জানতেন এবং ঢাকায় এসে উঠেছিলেন সুহৃদ কাজী মোতাহার হোসেনের বাসায়। পারিবারিক সূত্রে সেসব গল্প শুনে বড় হয়েছেন সন্‌জীদা খাতুন। ফলে নজরুল ছিল আজন্ম তাঁর সাথী, রবীন্দ্রনাথ বিকাশের অবলম্বন। তিনি লিখেছেন, “বাংলা একাডেমির যে পুরোনো বাড়িটা ‘বর্ধমান হাউস’, সেইখানে আমার বাবা তখন থাকতেন। সেই বাড়িতে ছিল কাঠের সিঁড়ি, সেই কাঠের সিঁড়ির ওপর থেকে ছুটে নেমে যেতেন নজরুল, আবার বড়দিকে কোলে নিয়ে ছুটে ওপরে উঠতেন। আর বড়দির সঙ্গে এতটাই ভাব ছিল যে, একবার ঘরোয়া আসরে কোলে বসিয়ে বড়দিকে দিয়ে গান গাইয়েছিলেন, ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল’।” এটা ভাবতে ভালো লাগে যে, এই বর্ধমান হাউসেই প্রতিষ্ঠা পায় বাংলা একাডেমি, শিক্ষা শেষে সন্‌জীদা খাতুনের প্রথম চাকরি-স্থল, গবেষণা সহকারী হিসেবে। আরও পরে ১৯৬২ সালে যখন ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন যাত্রা শুরু করে তখন এই বর্ধমান হাউসের তিনতলার হলঘরে প্রথম পাঠদান শুরু হলো।

নজরুলের আরেক প্রভাব রয়ে গিয়েছিল গৃহে। সন্‌জীদা খাতুন লিখেছেন, ‘আমার বাবা নজরুলকে প্রতিভা বসুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রতিভা বসু ভালো গান গাইতেন। তাঁর গান শুনে নজরুল মুগ্ধ হয়ে তাঁকে গান শেখাতে চাইলেন। অনেক গান শেখালেন। তো পাড়ার ছেলেরা দেখে, এই একটা লোক, মুসলমান, যখন তখন আসছে, আর বের হচ্ছে রাত করে, তো তারা একদিন লাঠি নিয়ে ঘেরাও করল নজরুলকে, মারবে। নজরুল চারদিকে ঘেরাও হয়েছেন বুঝতে পেরে একজনের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে ওদের এমন পিটুনি দিলেন যে সব ভাগল। লাঠিটা এনে আমাদের বাসায় রেখেছিলেন এবং আমরা বলতাম নজরুল-মারা লাঠি। সেটা আমাদের বাসায় অনেক দিন ছিল, পরে আর দেখিনি।’

কুসংস্কার ও অন্ধকারে শক্তিকে আঘাত হানতে নজরুলের যে লাঠি সেটাও এক অর্থে প্রতীকী তাৎপর্য ও পরম্পরা বহন করে। এই সময়ের আরও এক মধুর স্মৃতির উল্লেখ করেছেন কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর ‘স্মৃতিপটে নজরুল’ গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন, ‘বর্ধমান হাউসে আমার ভাইবোনসহ অনেক লোক থাকায় আমি বাইরের ছোট ঘরটায় নজরুলের সঙ্গেই এক বিছানায় শুয়ে রাত কাটাতাম। একদিন প্রাতে উঠে দেখি নজরুল বিছানায় নেই, ব্যাপার কী? পরে অনেক বেলাতে জানা গেল কখন যেন তিনি আলগোছে চলে গিয়েছিলেন, … রমনা লেকের ধারে এসে দিনান্তের বিকালবেলাটার অভ্যাসটা সম্প্রসারিত করে সেদিনের নিশান্তের শেষ যামটাও সেখানে বসেই লেকের পানি, গাছপালা ও লতাপাতা দেখে দেখে কাটিয়ে দিয়েছিলেন।’
ভাবতে ভালো লাগে তাদের আবাস থেকে বের হয়ে বিদ্রোহী কবি রমনা লেকের ধারে গাছপালার নিচে যেখানে একান্তে বসে প্রভাত সূর্যের উদয় দেখেছেন, সেখানেই বটমূলে ১৯৬৭ সাল থেকে বাংলা গানের আবাহনী সুর ও বাণী ঝংকৃত করে সন্‌জীদা খাতুনের নেতৃত্বে ছায়ানট পরিবেশন করছে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। সংস্কৃতির শক্তি ও পরম্পরা এভাবেই বহমান রয়েছে সন্‌জীদা খাতুনের পৌরহিত্যে, জাতির জন্য যা পরম আশীর্বাদ।

কত ভাবেই-না ইতিহাসের ছিন্নসূত্রগুলো একত্রে গেঁথে আবার মালা তৈরি করছেন সন্‌জীদা খাতুন। বাল্যে স্কুলছাত্রী হিসেবে তিনি ব্রতচারীর দীক্ষা নিয়েছিলেন পটুয়া কামরুল হাসানের কাছে। দেশভাগ-পরবর্তী সেই দুঃসময়ে এমনি কর্মশিবির সংগঠন ও তাতে যোগদান ক্লিষ্ট বর্তমান পেরিয়ে আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নবীজ বুনে দেয় চিত্তে-মনে। ১৯৬৯-এর উত্তাল দিনগুলোতে ছায়ানট আবার ব্রতচারী গানে মানুষ মাতায়, ‘বাংলা মার দুর্নিবার আমরা তরুণ দল,’ কামরুল হাসান পরিচালনা করেন ব্রতচারী কর্মশিবির নতুন কালের ছেলেমেয়েদের নিয়ে, অনুষ্ঠান নিবেদিত হয় শহীদ মিনারে। তারই ধারাবাহিকতায় আজকের দিন স্কুলে স্কুলে ব্রতচারী প্রবর্তন ও প্রশিক্ষণের কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সন্‌জীদা খাতুন। মুক্তিযুদ্ধকালে উদ্বাস্তু জীবনে তিনি গড়ে তোলেন ‘মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’, মহড়ার জন্য ঘর পাওয়া গেল ১৪৪ ধর্মতলা স্ট্রিটে, যে-ঘর ১৯৪০-এর দশকে আইপিটিএর উদ্দীপক গানে সৃজনে মুখর ছিল, সেখানেই সন্‌জীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক আরেক প্রতিরোধী সংগীতধারা সূচিত করলেন তিন দশকের পরে।

আরও কতভাবে যে ইতিহাসের পরম্পরায় আমরা পাই সন্‌জীদা খাতুনকে তা বলে শেষ করা যাবে না। তাঁকে আমরা বিভিন্ন পরিচয়ে জানছি, কিন্তু তিনি ছাপিয়ে যান সব পরিচয়ের বৃত্ত বা গণ্ডি। রবীন্দ্রসংগীতের সাধিকা, রবীন্দ্র-জীবনাদর্শে প্রাণিত সন্‌জীদা খাতুন বাঙালির ও বিশ্বমানবতার দীক্ষা পেয়েছেন কবির জীবন ও কর্মদর্শন থেকে, বাস্তবে সেই শিক্ষার প্রসারণ ও নবায়ন ঘটিয়ে চলছেন কত বিচিত্রভাবে। তাঁকে শুদ্ধাচারী সংগীতশিক্ষক হিসেবে সবাই জানে, তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন স্বাধীন বাংলাদেশে কোন সুরে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া হবে সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণে। সহজ সমাধান ছিল স্বরলিপি অনুসরণ করে গাওয়ার, তবে দেশের মানুষ গানটি গেয়েছে সুচিত্রা মিত্রের রেকর্ড অনুসারে, সেখানে স্বরলিপির হেরফের ঘটলেও সেই সুরের গানের মধ্য দিয়েই বাঙালি দেশচ্ছবি এঁকেছে অন্তরে। প্রচলিত ও বহুলভাবে প্রাণিত করা সেই সুর তো উপেক্ষা করা যায় না। তাই স্বরলিপির নির্দেশ ছাপিয়ে লোক-ব্যবহৃত সুরকে বহাল রাখার পক্ষে অবস্থান নেন সন্‌জীদা খাতুন, স্বরলিপির শুদ্ধতার চেয়ে দেশের ডাকই তাঁর কাছে বড় হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের এই অবস্থান মান্য করে সেই অনুযায়ী নতুন স্বরলিপি প্রণয়ন ও মুদ্রণ করে বিশ্বভারতী তুলে দেয় সরকারের হাতে, নেপথ্যে যার উদ্গাতা ছিলেন সন্‌জীদা খাতুন ও তাঁর কতিপয় সহযোগী।

সত্যিকারভাবে ইতিহাসের কন্যা ও ধাত্রী সন্‌জীদা খাতুন, ইতিহাস তাঁকে অনেক দিয়েছে, তিনি সেসব ফিরিয়ে দিয়েছেন ইতিহাসকে। নিরন্তর চলেছে তাঁর সাধনা দেশের সমাজের ও মানুষের মুক্তির জন্য, যে-মুক্তি আলোয় আলোয়, এই আকাশে ধুলোয় ধুলোয় ঘাসে ঘাসে। এমন মানুষটির পরিচয়দান সহজ নয়, সেই অসাধ্য প্রয়াস অব্যাহত থাকুক আজ তাঁর জন্মতিথিতে শ্রদ্ধার অর্ঘ্য নিবেদন করে।

লেখক: গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here