সফিকুল হাসান সোহেল
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনন্য সিলেট বিভাগ। সবুজ চাদরে বিছিয়ে আছে চা বাগানগুলো। দেখলেই নয়নমন জুড়িয়ে যায়। কিন্তু ব্রিটিশদের হাতে গড়া এই চা বাগানগুলোতে লুকিয়ে আছে কত শত রক্তপাতের ঘটনা। সংগ্রাম, শোষণ আর শাসনের ইতিহাস। নারীর ইজ্জত আর সম্ভ্রমহানির ঘটনা।
অমাবস্যা শেষে আকাশটা আজ পরিষ্কার। এক ফালি চাঁদ আর তারাদের আলোতে অসাধারণ পরিবেশ। সবুজ চা গাছে যেন দুধের মতো চাঁদের আলো উছলে পরছে। এক নৈসর্গিক পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। আহ কি সুন্দর। কিন্তু ঠিক এর বিপরীত মানুষের মন। কুৎসিত, পাশাপাশি অবস্থান করে। গীতা আর গভীন এর সেই প্রেম কাহিনী আজো যেন মানুষের মুখে মুখে ফেরে। তথাকথিত সভ্য নাগরিক সমাজকে হার মানায়। কত বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই স্মৃতি আজও মূর্তিমান। আর অশরীরী আত্মা কেন আজো সামনে এসে দাঁড়ায়। কুলি সর্দার দেবেশ কেন তাকে এত কঠিন শাস্তি দিল? জাত মান এসব কি সব? ছায়াবৃক্ষগুলো এক একটা ভুতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। বুনো ফুলের ঝাঁঝালো গন্ধ পরিবেশকে ভারী করে তুলেছে। এক একটা চা বাগান নিয়ে এক একটা সাম্রাজ্য। সব কিছুই অন্য রকমের। মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকার বিরামহীন ডাক রাতটাকে ভুতুড়ে করে তুলেছে। সুনশান নীরবতা চারপাশ। নিশাচর বাগদাশ , শেয়াল, বেজি, শুয়োর এদিক ওদিক লক্ষ্যহীন হাঁটাহাটি করে যায়। পাখিগুলো পিলে চমকানো ডাক দিয়ে যায়। দিন হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের অভিযান চলে। তাদের বিচরণ আরো ভয়ের সৃষ্টি করে। গহীন রাতের বুক চিরে ভেসে আসে এক শিশু ও তার মা এর অশরীরী ভয়ানক আর্তনাদ। যা রাতকে আরো ভারী করে তুলে। আর সেই বুড়ো বট গাছটা, আজও দাঁড়িয়ে আছে, স্মৃতি হয়ে। যেটাতে গীতাকে ঝুলিয়ে রেখে তিলতিল করে কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। একটা মানুষও টু শব্দও করতে পারেনি। সর্দার এর মুখের সামনে দাঁড়ানোর মতো সাহস তাদের কারো ছিল না। এখনও কি আছে? সেদিন শ খানেক মানুষ সমস্বরে বলেছিল,
হামার সর্দার যা বুইলেছে তাই কুরতে হইবেক।
তাহার ওপর কথা কুইবে নাকো কেহ।
হামদের বাগান লাগে,হামদের সর্দার।
দেবেশের সব কিছু মাফ। সারারাত নাচ গান পান আর রঙ্গলীলা করাই তার নেশা। বাগানের কোনো বাচ্চা মেয়েও তার হাত থেকে রেহাই পায়নি। চোখ পড়লেই ভোগ না করা পর্যন্ত তার নিস্তার নেই। কিশোরী, যুবতী, পোয়াতি, বুড়ি কেউ না। অথচ সে-ই করে সালিশি। সর্দারি। মান্য করে সবাই। ব্রিটিশদের পলিটিক্স। তারা নয়। শ্রেণী বিভাজন সৃষ্টি করে তাদের রাজত্ব টিকে রাখার ফন্দি। স্বজাতি দিয়েই কঠিন শাষণ।
গভীন বাইরে থেকে এসে বাগানে চা তোলার কাজ করত। বছরব্যাপী গীতার দলে থেকে কাজ করছিল। আস্তে আস্তে গীতার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়। সময়ের সাথে সাথে তাদের মনেও প্রেম আসে। কত গল্প, কত ধরনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। কেমন সংসার হবে। পরিকল্পনা করে নিজের সাধ্য আর সামর্থ্যকে সঙ্গী করে। গীতা বাগানের স্থায়ী কর্মী। তাদের কয়েক পুরুষ এই বাগানেরই সাথে জড়িত। একদিন চা পাতা তুলতে তুলতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে তারা দুজন। কাঁধের বোঝা পাশে রেখে সবুজ ঘাসে শুয়ে পড়ে দুজনই। একজন আরেকজনকে একান্তে স্পর্শ করতে থাকে। মনের মাঝে তুফান। একটু একটু করে এগুতে থাকে। শেষ সীমানায়। কোনো কিছুই তাদের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। জানে না বুঝে না এর শেষ পরিণতি। সে এক কঠিন আকর্ষণ। দুই প্রাপ্তবয়ষ্ক যুবক যুবতীর। সেই মুহূর্তে বুঝতেও চায় না তাদের মন। এক অমোঘ আকর্ষণে পতঙ্গের মতো আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো অবস্থা তাদের। স্বেচ্ছায় সঁপে দেয় একজন আরেকজনকে।
হামার এখন কি হইবেক।
এ প্রশ্নের সঠিক উত্তরও জানে না গভীন। শুধু বলে,
চিন্তা করিস না আমরা পালাইয়া যাইবেক এখান থাকি দূরত। সেখানে গিয়া সংসার পাতবেক।
সময়ের সাথে সাথে ভয় বাড়ে গীতার। ওর ভয় শুধু দেবেশের। গীতা যেন দিন কে দিন নিজের ভেতর ডুবে যাচ্ছে। শরীর দিন কে দিন ভারী হচ্ছে। কিছু খেতে পারছে না বমি হচ্ছে। শরীর ভেঙে আসে কাজ করতে ইচ্ছে করে না। চোখ জুড়ে শুধু ঘুম আর ঘুম। গীতা একদিন কাজে না আসলে গভীন অস্থির হয়ে পড়ে। ওকে দেখার জন্য পাগল হয়ে ওঠে। গীতার মা টের পেয়ে মেয়েকে নানা ধরনের বনাজি ওষুধ খাওয়ায় যাতে বাচ্চাটা পেটে না থাকে। কিন্তু কাজ হয় না। গীতার পেটের অবস্থা দেখে আস্তে আস্তে সকলেই জেনে যায়। গভীনকে চাকরি থেকে বাদ দেয়া হয়। কিন্তু সে যেতে চায়নি কারণ গীতা। তাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। তার জন্য ভীষণ মার খেতে হয়েছে গভীনকে।
তারপর একদিন সর্দার পঞ্চায়েত ডাকল। পঞ্চায়েত বলে আলাদা কিছু নেই সবই তার লোক। একঘরে করার সিদ্ধান্ত হলো। মা মেয়েকে এক ঘরে করে রাখার সিদ্ধান্ত হলো। পাড়ার কজন লুকিয়ে লুকিয়ে মাঝে মাঝে তাদের খাবার দিয়ে আসে। কাজও বন্ধ তাদের। উপোস প্রায়। দিন কে দিন কঠোর থেকে কঠোরতর হয়ে যাচ্ছে। এদিকে ৮ মাসের পোয়াতি গীতা। ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে মা-মেয়ে শুধুই কান্নাকাটি করেই যাচ্ছে। রাত একটু গভীর হলে নিকট প্রতিবেশী শ্যামলির মা সামান্য একটু ভাত আর আলু ভর্তা সাখে কচি চা পাতার ভর্তা নিয়ে সংগোপনে ওদের ঘরের দিকেই যাচ্ছিল। কিন্তু বিধিবাম। একেবারে সর্দার দেবেশের সামনে পড়ে গেল।
খাওন নিয়ে যাইছস কেনে?
হামার সহ্য হইছে না বাবু, ওদের কানদা।
সহ্য করতে না পারলে তোহাক আমি একঘরে কইরে রাখবেক।
এই বলে শ্যামলির মাকে টেনে হিঁচড়ে অন্ধকারে নিয়ে যায় দেবেশ…
গীতার শাস্তি হবে, কঠিন সেই শাস্তি। যাতে সবাই তাকে দেখে এই ধরণের পাপ আর কেউ যেন না করে।
সিদ্ধান্ত হলো চা বাগানের প্রাচীন বুড়ো বটগাছের সাথে বেঁধে রাখা হবে। প্রচুর লাল পিঁপড়ার বাসা সেখানে। ওদিকে গীতার তখন ৯ মাস চলছে। খেতে না পেয়ে এমনিতেই দুর্বল। যে কোন সময় প্রসব বেদনা উঠতে পারে। গীতার মা-কে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তবে গীতার কাছে যেন না যায় সেই জন্য কঠোর হুঁশিয়ারি জারি করা হয়েছে। আশ পাশে শত শত শ্রমিক সব নীরব। তারা শুধুই দর্শক। তামসা দেখছে শুধু।
সোমবার সকালে গীতাকে টেনে হিঁচড়ে এনে বেঁধে রাখা হয়।
খানিকক্ষণ পর থেকেই শুরু হয় গীতার আর্তনাদ। আস্তে আস্তে তা বাড়তে থাকে। সময়ের সাথে সাথে ভারী হতে থাকে। লাল পিঁপড়াদের কামড়ও বাড়তে থাকে। কোনো খাবার নেই, পানি নেই।
তোমাদের পায়ে পড়ছি। হামার একটু জল দিবেক তোহারা।
জল! পাপের শাস্তি বইলে কথা। আবার জল চাইছস।
সর্দার একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে।
রাত তখন গভীর। পুরো বাগানে সুনশান নীরবতা। দূরে রাতের পাখিরা ডানা চাপটায়। আরো দূরে শিয়ালের সম্মিলিত হুক্কা হুয়া শোনা যায়। কেমন গা ছমছম পরিবেশ। তাকে চোখে চোখে রাখা হচ্ছে যাতে কেউ ওকে সাহায্য করতে না পারে। সর্দারের চামচারা সদা তৎপর। রাত আরো গভীর হতে থাকে ঠিক সেই সময় গীতার প্রসব বেদনা ওঠে। ব্যথায় আর পিপঁড়ার কামড়ে শুধু ছটফট করছে। কেউ কাছে যাচ্ছে না ভয়ে। এ অবস্থায় পাষাণ হৃদয়েও মন গলবে। কিন্তু ওর মন গলছে না। গীতার মা পায়ে ধরছে অনবরত সর্দারের। সে ভয় দেখাচ্ছে
তুই বড় বেশি বকছিস। তোহাকেও বেইধে রাখা হইবেক বেশি বাড়লে।
খুব ভোরে বাচ্চার কান্না শোনা গেল। কাউকেই কাছে যেতে দেয়া হলো না। সময়ের সাথে সাথে বাচ্চার চিৎকার অনবরত বাড়তে লাগল। সবাই বুঝল বাচ্চাটাকে অনবরত পিঁপড়া কামড়াচ্ছে। তবুও সর্দারের মন গলল না। ঠাঁই বসে রইল। গীতা বাচ্চাটাকে কোলে নেবার জন্য বার বার চেষ্টা করছে কিন্তু হাত দুটো শক্তভাবে বাধা থাকার জন্য নড়াচড়া করতে পারছে না। কি করে পারবে? এক সময় বাচ্চার চিৎকার কমতে শুরু করে। সময়ের সাথে সাথে নিথর হয়ে যায়। নিথর হয়ে যায় চারপাশের পরিবেশ। গীতার শুধুমাত্র কান্নাই সম্বল। এক সময় সেটার শক্তিও থাকে না তার। গোঙানির আওয়াজই বের হতে থাকে।
সূর্য ওঠার সাথে সাথে গীতার মা দৌড়ে মেয়ের কাছে গেলেও তখন আর কিছুই করার নেই। সব কিছুর উর্ধ্বে উঠে গেছে তারা। চারপাশটা শুধুই রক্তের ধারা। কী বিভৎস দেখতে লাগছে বাচ্চাটা। শরীরের মাংসগুলো খাবলা খাবলা আর কয়েকটা রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে। নবজাতকের চোখ থেকেও রক্ত বের হচ্ছে অনবরত। মেয়ের শক্ত বাঁধন খুলে দিতেই গীতা কাটা গাছের মতো ঝুপ করে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। চোখ দুটো আস্তে আস্তে স্থির হয়ে গেল। মা-র কোলেই এক সময় নিস্তেজ হয়ে গেল। মা-বাচ্চার জীবনের এভাবেই অকাল যবনিকা ঘটলো।
আজও রাত যত গভীর হতে থাকে প্রথমে মা-বাচ্চার ছটোছুটি আর হাসি শোনা যায়। সময়ের সাথে সাথে আস্তে আস্তে বাচ্চার বিরামহীন কান্না ভেসে আসে বাতাসে। তা ছড়িয়ে পড়ে চারপাশ। বাতাসও তখন যেন থেমে যায়। দুঃখের সাথে দুঃখী হয়ে উঠে। বিশেষ করে অমাবস্যার সময় যখন চারপাশটা পিচের মতো কালো হয়ে উঠে এক ভয়ানক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। অশরীরী আত্মাগুলো ছুটাছুটি করে। ভয়ে কেউ ঐ গাছটার আশপাশে আসে না। বাচ্চাটার অশরীরী আত্মা এখনো মনে করিয়ে দেয় মানুষের পৈশাচিক উল্লাস। মানুষ নামের পশুর নির্মমতার কথা। এভাবে অতৃপ্ত আত্মাগুলো না পাবার বেদনা নিয়ে পৃথিবীতে ছুটাছুটি করে। ভয় দেখায়।