গল্প : বিনি সুতার মালা

0
52

ওয়াহিদ জামান

ঘাটে নাও বেঁধে ডাঙায় ওঠে ফরিদ মাঝি। আশপাশে তেমন কোনো দোকানপাট নেই। সপ্তাহের হাট হলে মন যা চায় কিনতে পারে না। দু’পাঁচটা দোকান যা আছে তেমন কোনো সওদা পাতি নেই। মাঝখানের এক দোকান থেকে কেজি দুই মোটা চাল, আলু পেয়াজ কিনে নাওয়ে আসে ফরিদ মাঝি। দুপুরের গনগনে রোদে মাথার টিকলি জ্বলে যাচ্ছে তার। দক্ষিণের শো-শো বাতাসে চুলা জ্বালাতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু করেছে সে। ছইয়ের ভিতর নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে জয়নাল। জয়নাল ফরিদ মাঝির বড় ছেলে। চৈত্র বৈশাখ মাসে সূর্যের আগুন ঝরা তাপে একা নাও চালাতে পারে না ফরিদ। তাই এ সময়টাতে জয়নালকে সাথে রাখে।
চুলা জ্বলছে কিন্তু বাতাসে আগুন দাউ দাউ করে নেচে উঠছে। বাতাস না থাকলে দ্রুত চাল সিদ্ধ হতো। আগুনের নাচনে পাতিলের তলায় ঠিক মতো তাপ লাগছে না। গরিবের জীবন ঠিক আগুনের নাচনের মতো। গনগনে আগুন দাউ দাউ করে বুকের মধ্যে নাচে। মাথার ওপরে নিষ্ঠুর সূর্যটা পশ্চিমে হেলতে শুরু করেছে। জয়নাল তখনো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। ছেলেটার আলসেপনা ফরিদের সহ্য হয় না। মাথার টিকলি জ্বলা তাপের মতো তার মেজাজও জ্বলে ওঠে। চিৎকার করে ডাক দেয়, ওই হারামজাদা মরনের ঘুম দিলি নাকি, ওঠ।
জয়নাল ফরিদের চিৎকারে লাফিয়ে ওঠে। এদিক সেদিক তাকায়। ফরিদ তখনো ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে, কি দ্যাহোস। বাপরে এট্টু সাহায্য করণ যায় না? অলক্ষুণে পোলা।
জয়নাল বুঝতে পারে রান্নার ব্যাঘাত হচ্ছে বলে তার বাবা রেগে গেছে। দ্রুত চুলার ধারে আসে। আলু পেয়াজ কেটে নদীর জলে ধুয়ে ফেলে। ডাল আর আলু একসাথে ঝোল করে জয়নাল। জয়নালের রান্নার হাত ভালো। সবচেয়ে বড় গুণ সে কখনো বাবার সাথে তর্ক করে না। তার একটাই সমস্যা-আলসেমি।
দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নেয় পিতা-পুত্র। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে বেশ হেলে পড়েছে। ফরিদ জয়নালকে বলে নাও ছাড়ার জন্য। জয়নাল নাও ছাড়ে। বাতাসের অনুকূলে পালতোলা নৌকা দ্রুত গতিতে ছুটে চলে। খোলপেটুয়া নদী রেখে মরিচ্চাপ নদীর শেষ প্রান্ত অতিক্রম করে বেতনা নদীর নদীর বুক চিরে বড়দল অভিমুখে এগিয়ে চলে নৌকা। আজকাল মানুষ নাও চড়ে না। গাড়ি আর নামীদামী লঞ্চের দৌরাত্ম্যে পুরান কালের যানবাহন-নৌকা আর কেউ চড়তে চায় না। ফরিদ এখন নাও-এ মালপত্র টানে। বড়দল বাজার এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মোকাম। খুচরা ব্যাবসায়ীদের মালপত্র টেনে যা হয় তাই দিয়ে ফরিদের সংসার চলে। জীবনের মাঝপথে এসে নতুন কোনো কাজে তার মন বসে না তার। বাপদাদার পুরনো পেশা নৌকা চালানো, ফরিদ এখনো তা ধরে রেখেছে। নৌকা ছুটে চলে আপন গতিতে। সন্ধ্যা নাগাদ বড়দল মোকামে এসে নাও ভেড়ে।

দুই
বড় দল মোকামের উত্তরপূর্বকোণে কয়েকটি ছোট ছোট ঘর। সারিবদ্ধ ঘরগুলোর একবারে শেষ ঘরটায় থাকে কমলা সুন্দরী। বাজারের অনেক দোকান মালিকের সাথে তার বেশ সখ্য। কথিত আছে কমলা সুন্দরীর কাছে তাদের রাত-বেরাত যাওয়া আসা আছে। ফরিদ খেটে খাওয়া এক মাঝি। যার নুন আনতে পান্তা ফুরায়। কমলা সুন্দরী তার প্রেমে পড়ে। কমলা সুন্দরীর ঘরটার কোল ঘেষে নদী পাড়ে নাও বাঁধে ফরিদ। অনেক দিন ধরে দেখাদেখি কথা বলার মাঝে ফরিদের মনে ধরে যায় কমলা সুন্দরীকে। কিন্তু লাজলজ্জার ভয়ে কোনো দিন মনের কথা বলা হয়নি তার। তাছাড়া বড় ছেলে জয়নালের কারণে ফরিদ অনেক সুযোগ পেয়েও কমলার কাছে সে নিজের মনের কথা বলতে পারিনি। সেদিন সওদাপাতি কিনে নাওয়ে আসার সময় কমলা সুন্দরী ফরিদের পথ আগলে রাখে। কমলার অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ ফরিদ নির্বাক হয়ে যায়। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। শুধু অপলক নয়নে কমলা সুন্দরীর সৌন্দর্য উপভোগ করে। কমলার উন্নত বক্ষ মেদহীন তলপেট, লাউয়ের ডগার মতো মসৃণ বাহু ফরিদকে পাগল করে তোলে। ফরিদকে নিরব দেখে কমলা সুন্দরী বলে, হ্যাগো মাঝি কিছু কইবা না?
ফরিদ আশপাশে চোখ বুলায়। দেখে কোনো মানুষজন নেই। কিছু একটা বলতে চায় কিন্তু পারে না। কমলা সুন্দরী তখন বলে, তুমি এতো ভয় পাও ক্যান মাঝি।
ফরিদ যেন সাহস পায়। বীর পুরুষের মতো বলে, ক্যান ভয় পামু। তুই বাঘ না ভাল্লুক।
ফরিদের কথা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে কমলা। লোকচক্ষুর ভয়ে ফরিদ বলে, এতো জোরে হাসতাছোস ক্যান? মানসে কি কইবো।
এইবার কিন্তু ঠিকই ভয় পাইছো।
কমলা সুন্দরীর কথা শুনে লজ্জিত হয় ফরিদ। আমতা আমতা করে বলে, কী কইতে চাইছিলি কইয়া ফ্যাল। আমার অতো রংতামাশার সময় নাই।
কমলা সুন্দরী ফরিদের আরও কাছে এসে শরীর ঘেঁষে দাড়িয়ে বলে, রাতে আমার ঘরে আইবা মাঝি?
এমন প্রস্তাবে হতবাক হয় ফরিদ কিন্তু মনের কোনে কেমন যেন একটা টান অনুভব করে। কমলার মতো রূপসী নারীর আহবান অবজ্ঞা করার মতো সাহস তার নেই। তাছাড়া সে মনে মনে কমলা সুন্দরীর প্রেমে পড়েছে অনেক আগে।
ফরিদ কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলে, তোর ঘরে ক্যান আসুম।
কমলা সুন্দরী ফরিদের কথা শুনে হাসতে থাকে। আশপাশের মানুষের ভয়ে ফরিদ তার মুখ চেপে ধরে। বলে, এতো হাসোস ক্যান। মানসে শুনলে কি কইবো।
কমলা ফরিদের কথার জবাব না দিয়ে দৌড়ে নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকে। যাবার সময় বলে, আইবা কিন্তু মাঝি। তোমারে আমার মেলা ভালো লাগছে।
ফরিদ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে।

তিন
মাঝ রাত। বেতনা নদীর জল কূলে এসে আঁছড়ে পড়ছে। জয়নাল অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ভাঙা ছইয়ের ছিদ্র দিয়ে রুপালি চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে তার মুখে। সমস্ত পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়েছে কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই। ঢেউয়ের জল কূলে আছড়ে পড়ছে, সেই সাথে দুলে উঠছে ফরিদের নাও। নদীর জলের ঢেউ যেন মাঝে মধ্যে কূলে না পড়ে ফরিদের বুকে এসে আছড়ে পড়ছে। ছইয়ের ফাঁক দিয়ে কমলা সুন্দরীর ঘর দেখা যায়। ঘরে ছোট্ট একটা বাতি জ্বলছে টিমটিম করে। ফরিদের গায়ে কে যেন বারুদ লাগিয়েছে। সমস্ত শরীর ঘেমে জবজবে। কেন যেন নিজেকে পঁচিশ বছরের তরুণ মনে হচ্ছে তার। অস্থির ফরিদ আশপাশে ভালো করে নজর দেয়। একটা বিড়ি জ্বালায়। লম্বা টান মারে আর মনের মধ্যে সাহস সঞ্চয় করে। জয়নালের শিয়রের কাছে দু ব্যাটারির টর্চ লাইটটা হাতে নেয়। কয়েকটি সুখটান দিয়ে বিড়িটা নদীর জলে ফেলে দেয়। আস্তে ধীরে নাও থেকে ডাঙায় ওঠে।
ঘরের দরজার কাছে যেতেই ধপাস করে দরজা খুলে দেয় কমলা। সে ফরিদের অপেক্ষায় ছিল। ফরিদ লাফিয়ে ওঠে। ফিসফিস করে বলে, এমুন করে কেউ দরজা খুলে?
কমলা মৃদু হেসে বলে, ডর লাগে?
– লাগবো না। তোর মানইজ্জত না থাকুক আমার তো আছে।
কমলা সুন্দরী ফরিদের কথায় কোনো রাগ করে না। হাসতে হাসতে বলে, তোমারে আমার মেলা ভালো লাগছে মাঝি। ক্যান জানি তোমারে খুব আপন মনে হয়।
– জ্ঞান দেওনের জন্য ডাকছোস?
– তুমি দেখছি অন্য পুরুষ মাইনসের মতো। মাইয়া লোকের কাছে আইলে তর সয়না।
ফরিদ লজ্জা পায়। একফালি নীরবতা তাকে গ্রাস করে। কমলা সুন্দরী বুঝতে পারে ফরিদ লজ্জা পেয়েছে। খুব কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বলে, তোমারে তো সব দেবার জন্য ডাকছি মাঝি। তোমারে আপন মনে হয় তাই মনের দুটো কথা কইবার চাইছিলাম।
ফরিদ কোনো কথা বলে না। কমলা সুন্দরী বলেই চলে, জানো মাঝি কত পুরুষ মানুষ দেখলাম। সবাই শুধু আমার শরীরটা কিনবার চায়। মনডা কেউ কিনবার চাইলো না। তুমি কিনবা মাঝি?
কমলার মুখে দামী কথা শুনে অবাক বিস্ময়ে তার মুখপানে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কমলার কথা বলার ঢঙ তাকে গভীর ভালোলাগায় মুগ্ধ করে। অস্ফুটস্বরে বলে, বেঁচলে কিনুম।
ফরিদের কথা শুনে কমলা ঈষৎ কেঁপে ওঠে। চিবুকে চুমু খেয়ে বলে, মেলা দামী কথা কইছো মাঝি।
ফরিদ কিছুটা বেসামাল হয়ে পড়ে। কমলাকে বুকের মধ্যে শক্ত করে জাপটে ধরে বলে, তোরে এমনি করে রাখুমনে। যাতে কেউ তোরে কাইড়া নিতে না পারে।
কমলা সুন্দরী অবাক বিস্ময়ে ফরিদের কথা শুনে। ফরিদের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসতে থাকে। কমলা সুন্দরী বুঝতে পারে ফরিদের কষ্ট হচ্ছে। তাই সে ফরিদের ঠোঁটে আলতো করে চুমু খায়। আর বলে, তোমার কষ্ট হচ্ছে বুঝবার পারছি। সুখ নাও যতো পারো আজ।

চার
কমলা সুন্দরীর ঘরে ফরিদের যাতায়াত এখন নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা। বড়দল মোকামে নাও ভিড়ালে প্রায় প্রতিদিন সে কমলার কাছে যায়। একটা লাল পাড়ের শাড়ি আর আকাশী রংয়ের ব্লাউজ কিনেছে ফরিদ। আজ তার তেমন বাঁধা নেই। ছেলে জয়নাল বাড়িতে আছে, নাও-এ আসেনি।
দুপুরে বাজার থেকে সওদাপাতি কিনে নাও-এ আসার সময় কমলা সুন্দরীর সাথে দেখা হয় ফরিদের। ফরিদকে দেখে কমলা বলে, কি গো মাঝি। ঘাটে নাও ভিড়াইলা কখন?
– আজগে সকালে।
– রাতে আইবা মাঝি?
– আমুনে।
হাসতে হাসতে কমলা সুন্দরী চলে যায়। ফরিদ নাও-এ এসে দুপুরের রান্না করে। তারপর গাও গোসল দিয়ে দুপুরের খাবার খায়। মনটা আজকে তার বেজায় ফুরফুরে। একটা বিড়ি জ্বালায়। বিকালের মৃদু বাতাসে নাও এ বসে বিড়ি টানতে আলাদা মজা। বিড়ির টানের সাথে জীবনের অনেক ছন্দ মাথায় খেলে যায় তার। কমলা সুন্দরীর রুপলাবন্য বিড়ির ধোঁয়ার মধ্যে ভাসতে দেখে সে। মন তার অস্থির হয়ে ওঠে। সময় বড় নিষ্ঠুর মনে হয় তার। রাত যেন আড়ি পেতেছে তার সাথে। আজ আর সময় অতিবাহিত হতে চায় না। সময়ের নিয়মে সময় পার হতে থাকে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত আসে। ফরিদের আর তর সয় না। রাত এগারো-বারোটার দিকে ফরিদ শাড়ি আর ব্লাউজ একটা চটের থলেতে পুরে নাও থেকে ডাঙায় ওঠে।
কমলা সুন্দরীর ঘরের দরজার কাছে যায়। দরজায় কড়া নাড়ে। ভেতর থেকে কমলা সুন্দরী বলে, ধাক্কা মারো মাঝি দরজা খোলা আছে।
ফরিদ ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে যায়। মাটির প্রদীপটা যেন আজকে অন্য দিনের তুলনায় জ্বলছে বেশ। প্রদীপের আলোর চেয়ে কমলা সুন্দরীর রূপের আলো ঢের বেশি। বারেবারে ফরিদের চোখ ঝলসে যেতে থাকে। যেন স্বর্গের পরী এ ঘরে ঠাঁই নিয়েছে। তার রূপ-লাবন্য আগে কখনো এতোটা সুন্দর লাগেনি। ফরিদ বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। কী বলে প্রশংসা করবে বুঝতে পারে না। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। আচমকা ফরিদকে জড়িয়ে ধরে কমলা সুন্দরী। আদর মাখা কণ্ঠে বলে, এতো কি দ্যাহো মাঝি।
– তোর রূপ।
– ক্যান আগে কহনো দ্যাহো নাই।
– তুই আগের থেইকা সুন্দর হইছিস কমলা।
– সুন্দর তো আমি আগেও ছিলাম। কই আগে তো কখনো আমার রূপের এতো প্রশংসা করো নাই।
ফরিদ কিছুই বলে না। হাতে থাকা চটের ব্যাগটা কমলাকে দেয়। কমলা জিজ্ঞেস করে, এতে কি মাঝি?
– খুলে দ্যাখ।
কমলা সুন্দরী চটের ব্যাগটা খুলে। লাল পাড়ের শাড়ি আর আকাশী রংয়ের ব্লাউজ দেখে খুব খুশি হয়। কয়েক মূহুর্ত পরে ফরিদের মুখপানে কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, তুমি আমারে এতো ভালোবাসো মাঝি?
ফরিদ মাথা নেড়ে বলে, হুম।
কমলাকে গভীর মমতায় জড়িয়ে ধরে ফরিদ। তার শরীরের গন্ধে তীব্র মাদকতা অনুভব করে। মূহুর্তেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে তোলে কমলাকে। কমলাও অজানা ভালোলাগায় ফরিদকে জাপটে ধরে। যৌনতার তীব্র আকাক্সক্ষায় গোঙাতে থাকে দুজন। প্রবল আনন্দে আত্মহারা ফরিদ বলে, তোরে আজ শ্যাষ কইরা ফালামু।
– ফালাও তোমার যতো ইচ্ছে।
রাত গভীর হতে থাকে। সমগ্র মানব জগতে দুটি প্রাণী আজ নিদ্রাহীন। নিশাচর প্রাণীর মতো আহারের নেশায় তারা। অনেক গল্প, অনেক ভালোলাগা আজ সব সত্য মনে হচ্ছে তাদের।
ফরিদের বুকে মাথা রেখে কমলা সুন্দরী বলে, আমাগো এ সম্পর্ক কেমুন জানো মাঝি?
– কেমুন
– বিনা সুতার মালার মতো। স্বীকার করলে আছে, অস্বীকার করলে নাই।
ফরিদ কমলার কথা নীরবে শুনে। তারপর বলে, মেলা দামী কথা কইছোস। আমাগো সম্পর্ক তেমুন হইবো না।
– তাই যেন হয় মাঝি।

পাঁচ
কমলার সাথে ফরিদের সম্পর্ক যেন আত্মার সম্পর্ক। ফরিদ এখন অধিকাংশ সময় বড়দল মোকামের মালামাল নাও-এ টানে। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। বড়দল মোকাম ছাড়া আর কোনো মোকামে সে নাও ভিড়ায় না। কমলার ভালোবাসা তাকে অন্ধ করে ফেলেছে।
একদিন হঠাৎ কমলা সুন্দরী হন্তদন্ত হয়ে ফরিদের নাও-এ আসে। ফরিদ গাও গোসল দিয়ে দুপুরের খাবার খেতে বসেছে মাত্র। উদ্বিগ্ন কমলাকে দেখে খাবার না খেয়ে ফরিদ উঠে দাঁড়ায়। কমলার বিধ্বস্ত চেহারা দেখে শান্ত্বনার সুরে বলে, কি হইছে তোর। এমন করতাছোস ক্যান।
কমলা সুন্দরী ডুকরে কেঁদে ওঠে। ফরিদকে জাপটে ধরে কাঁদতে থাকে। ফরিদ বলে, আহা কানতাছোস ক্যান। ঘটনাটা খুইলা ক।
– মাঝি, তুমি আমারে বিয়া করবা?
ফরিদ একটা ঝাঁকুনি খায়। তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। কমলার এমন প্রস্তাবের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। নিজেকে সামলে বলে, কী সব আবোল তাবোল কইতাছোস। কী হইছে আগে ক।
– তোমারে ভালোবাসার পর থেইকা আমি আর কোনো পুরুষ মানুষের কাছে শরীর বেঁচি নাই মাঝি।
– তাতো আমি জানি।
– সেটাই আমার কাল হইছে।
– সেটা তোর কাল হইবো ক্যান।
– মাঝি, আমাগো সমাজে পুরুষ মানুষের কোনো ধর্ম নাই। যখন আমার শরীরের স্বাদ ভোগ করবার পারছে না তখনই তারা গা-ঝাড়া দিয়া উঠছে।
– তুই এতো দামী কথা কইতাছোস ক্যান। সহজ কইরা ক।
– আমার কাছে ভিড়তে না পাইরা ওরা হিংস্র হইয়া গেছে। এ মাসের মধ্যে আমার ঘর ছাড়তে কইছে। অহন আমি কই যামু মাঝি?
ফরিদ ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায়। হঠাৎ এ পরিস্থিতিতে তার কি করা উচিত সে বুঝতে পারে না।
কমলা আচমকা ফরিদের পায়ে এসে পড়ে। ফরিদ হতবাক হয়ে যায়। টেনে তুলে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে, আমার জন্য আজ তোর এই অবস্থা।
– তোমারে আমি কোনো দোষ দেব না মাঝি। সবই আমার কপালে ছিল।
ফরিদ আর কোনো কথা বলে না। কমলা সুন্দরী ডুকরে কাঁদতে থাকে। ফরিদের কাছ থেকে কোনো সদুত্তর না পেয়ে বলে, কি গো মাঝি, কিছু কইবা না।
– কি কমু ক। তুই অহন ঘরে যা। রাতে আইয়া কমুনে।
কমলা সুন্দরী ঘরে ফিরে যায়। যাওয়ার আগে অসহায়ের মতো ফরিদের দিকে একবার তাকায়। ফরিদ কমলার দিকে তাকাতে পারে না। কমলার কমল দৃষ্টিতে এক নিষ্পাপ নারীর প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। সে চাহনিতে আছে আকুতি, গভীর বেদনা, আকাশের মতো বিশাল ভালোবাসার সুভাসিত পুষ্পবিতান। শান্ত্বনার স্বরে বলে, অহন যা তুই, রাইতে আমুনে।
রাত গভীর হয়ে আসে। কমলা সুন্দরী অধীর আগ্রহে ফরিদের অপেক্ষায় থাকে কিন্তু ফরিদ আসে না। অপেক্ষার যাতনা কতো প্রখর কমলা উপলব্ধি করে। একবার মনে হয়েছিল ফরিদের নাও-এ যাবে। কিন্তু মনে সে জিদ চেপে ধরে। রাত ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় দিনের কাছে। ফজরের আযান কানে ভেসে আসে। কিছুক্ষণ পরে রাতের নিস্তব্ধতা কেটে পাখিদের কলরব শোনা যায়। কমলার নিদ্রাহীন চোখ তখনো ফরিদের অপেক্ষায় ব্যাকুল।
পূব আকাশের সকালের রক্তিম সূর্যের আলো জানালার ফাঁক দিয়ে কমলার ঘরে এসে পড়ছে। কিন্তু সে আলো যেন নিষ্প্রভ। সোনালি আলো যেন সোনালি নয়, সে আলোয় আছে জীবনের ভর্ৎসনা, আছে অন্ধকারের প্রতিচ্ছবি। কমলা জানালার কাছে যায়। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে চমকে উঠে সে। ফরিদের নাও ঘাটে বাঁধা নেই। অস্থির কমলা ঘর থেকে বের হয়ে নাও-এর ঘাটে যায়। ঘাটে পাঁচ-ছয়টা নাও বাঁধা। কয়েকজন মাঝিকে জিজ্ঞেস করে, কেউ ফরিদের সন্ধান দিতে পারে না।
কমলা সুন্দরী বুকে একরাশ নিরাশার ঘনকালো মেঘ এসে ভেড়ে। বাধভাঙা আকুতি তার নিমেষেই নদীর ভাটার মতো অকূল বেদনার সাগরে গিয়ে মেশে। অস্ফুটস্বরে বলে, মাঝি তুমি সত্যি ফাঁকি দিছো।
কয়েক মাস পরে কমলাদের ঘর উচ্ছেদ করে বাজার কমিটি। কমলারা সবাই বাজার ছেড়ে চলে যায় অন্য কোনখানে।

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here