গল্প : অর্জনের দুরন্তপনা

0
48

আবদুর রহমান মল্লিক
অর্জনের দুরন্তপনার কোনো শেষ নেই। স্কুল ছুটি থাকায় তাকে আর পায় কে। ছকে বাধা জীবন থেকে তার যে মুক্তি মিলেছে। অর্জন পড়ত অষ্টম শ্রেণিতে। গ্রামে তখন গোল্লাছুট আর ডাংগুলি খেলা খুব জমে উঠত। খেলায় পটু হওয়ায় অন্য বালকেরা সহজেই তার নেতৃত্ব মেনে নিত। ডাং দিয়ে যখন গুলিটাকে কষে বারি মারত তখন গুলিটি শো শো শব্দ করে বহুদূর গিয়ে পড়ত।
কত ডাং হলো গুণে গুণে সবার চেয়ে এগিয়ে থাকত। জিতে যাবার সম্ভাবনায় ভেতরে ভেতরে পুলক অনুভব করত। সেদিন এক কান্ড হয়ে গেল। সে বুঝতেই পারেনি ঘটনাটি কেমন করে ঘটল। কারো এমন ঘটেছে বলেও কখনো শোনেনি সে। ওই দিন যখন কষে গুলিটাকে শূন্যে বারি মেরেছিল তখন পাশের বাবলা গাছের কান্ডে লেগে আধা হাত লম্বা গুলিটা তারই নাক বরাবর এসে আঘাত করল। মুহূর্তে তার মাথা যেন ঘুরে গেল। কতক্ষণ ঝিম ধরে রইল। কখন মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারেনি। নাকে রক্ত না ঝড়লেও নাকটা বেশ ফুলে উঠল। বন্ধুরা তাকে টেনে তুলল আর বাড়িতে পৌঁছে দিল। মা সাবধান করলেন, ওটা চোখে লাগলে কি হতো? এমন ব্যথা পাবার অভিজ্ঞতা তার নতুন নয়। ব্যথা পাবে বলে তো আর ঘরে বসে থাকা যায় না। তার দুরন্তপনার কাছে যেন সব হার মানে।
অর্জনদের বাড়ির সামনে রাস্তা। রাস্তাটা বাড়ির চেয়ে নিচু। রাস্তার পরেই তাদের বিরাট পুকুর। পুকুরের চালায় ছিল অনেকগুলো বাবলার গাছ। আট দশ হাত দূরে দূরে একটি গাছ ছিল সারিবদ্ধভাবে। পুকুর চালার চালে ছিল দুটো হিজল গাছ। একটি হিজল গাছের শিকড় ছিল ছড়িয়ে। পৃথক ঘাটলা থাকলেও হিজল গাছের শিকড়ে বসে আয়েস করে গোসল করা যেত। অর্জনরা দলবেধে আবার হিজল গাছের চুড়ায় উঠে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ত। এটা ছিল প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। অর্জন যখন তার বইয়ে ‘পিপড়া ও ঘুঘু’ গল্পটি পড়ত, তার মনে ভেসে ওঠত তাদের হিজল গাছের কথা। ঘুঘুটি যেন সেই হিজল গাছেই বসে ছিল। আর ঘুঘুটি যেন হিজল পাতা ওই পুকুরেই ফেলেছিল। আর পিপড়াটি পাতাকে আশ্রয় করে মরি মরি করে পুকুর পাড়ে এসে বেঁচে গিয়েছিল। আর শিকারীর হাত থেকে পাখিটাকে বাঁচাতে পিঁপড়ে তার পায়ে কামড়ে দিয়েছিল। এমন দৃশ্য তার মানসপটে ভেসে উঠত। পরপোকারীতার এই গল্পটি তার মনে গেঁথে গিয়েছিল। তার কিশোর মনে এমনি একটা ভাবনা জেগেছিল যে, মানুষের কল্যাণে সে সারাজীবন কাজ করবে। একটা পিঁপড়ে আর পাখি যদি এভাবে বিপদের সময় এক অপরের পাশে দাঁড়াতে পারে। মানুষ হয়ে আমি কেন পারবনা। স্বভাবে দুরন্তপনা থাকলেও একটা মানবিক মন ছিল অর্জনের মাঝে।
বর্ষার নতুন পানিতে পুকুরটির টইটুম্বুর অবস্থা। হিজল গাছটির ছড়িয়ে থাকা একগুচ্ছ শিকড়ের প্রায় অধিকাংশ পানিতে ডুবু ডুবু করছিল। সেদিন একাকী উদ্যেশ্যবিহীন ঘুরাঘুরি করে অর্জন গেল ওই হিজল গাছটির কাছে। কিন্তু অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে তারতো চোখ ছানাবড়া। নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। হিজলের শিকড়ের ওপর মাথা উচু করে বসে আছে বিশাল সাইজের এক গলদা চিংড়ি। সাড়াশির মতো মাথার কাটাটি যেন শত্রুর আক্রমন প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুত। এতো বড় চিংড়ি জীবনে দেখেনি অর্জন। চিংড়িটা কাউকে না জানিয়ে নিজে নিজেই ধরে ফেলবে সে উত্তেজনায় সে অস্থির হয়ে উঠল। চিংড়িটার পেছন দিকে অবস্থান নিয়ে পরিকল্পনা করতে থাকে। চিংড়িটার ঠিকরে পড়া দুটি চোখ যেন তাকেই লক্ষ্য করছে সম্ভাব্য শত্রু ভেবে। খপ করে খালি ধরতে গেলে সে রক্তাক্ত হবে। আনাড়িপনা করলে সেটা পানিতে লাফিয়ে পড়ে আয়ত্বের বাইরে চলে যাবে। জাল বা মাছ ধরার কোনো যন্ত্র এখানে কাজে আসবেনা এটা নিশ্চিত। তার কী করা উচিত ভেবে পায়না। হুট করে মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায় তার। সাবধানে পিছিয়ে এসে সে এক দৌঁড়ে বাড়িতে চলে গেল। ফিরে আসতে আসতে একটা বড় গামছা ডান হাতের কব্জি ও তালুতে পেঁচিয়ে নিল। এবার পা টিপে টিপে নিকটবর্তী হয়ে অতি সাবধানে চিংড়িটাকে খপ করে ধরে ফেলল।
এ বয়সে তার মাছ ধরার অভিজ্ঞতা অনেক হয়েছে। বড়শি দিয়ে কই মাছ ধরার সময় ছিপটি যেভাবে বাকিয়ে যেতো তা আয়ত্বে আনতে বহুবার হিমসিম খেয়েছে সে। পানিতে পেতে রাখা দুয়াইর (মাছ ধরার যন্ত্র) যখন রশি দিয়ে টেনে ওপরে তুলত তখন সাদা সাদা চিংড়িগুলো ঝমঝমিয়ে উঠত। কিন্তু আজকের একটা মাত্র চিংড়ি মাছ ধরার আনন্দ উত্তেজনা সম্পূর্ণ আলাদা। চিংড়িটা দুহাতে চেপে একটা অসাধ্য সাধন করার গৌরবে বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে গেল ভেতর বাড়িতে, একেবারে মায়ের কাছে। অবাক হলেন মা-ও। হাপাতে হাপাতে মাকে বলল মাছ ধরার গল্প। সন্তানের কোনো ছোট সাফল্যেও মা যেমন সবচেয়ে বেশি খুশী হন। অর্জনের এই কাজে মায়ের মুখে সে খুশীর দীপ্তি ফুটে উঠল। অর্জন মায়ের আঁচলে মুখ মুছে।
মা অর্জনের কাঁধে হাত রেখে বোঝালেন, এ ভাবেই ভয়কে জয় করতে হবে। আর নিজের ওপর বিশ্বাসটা রাখতে হবে। তা হলে জীবনে বড় বড় কাজ করতে পারবে। আর তোমার কাজ একদিন তোমাকে অনেক সম্মানিত করবে। মায়ের কথায় আপুত হয় সে। ভারী গলায় বলল, দোয়া করো মা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here